কলকাতার জন্য মন কাঁদছে জয়ার, লিখলেন বিষাদ ও সম্ভাবনার গল্প

0 ৩২৭

বিনোদন ডেস্ক: লকডাউনে ঘরবন্দি জয়া আহসান। লিখলেন অভিজ্ঞতার কথা।

‘কেমন আছি?’- এই প্রশ্নে আজকাল উত্তর দিতে পারি না। চুপ করে থাকি। আসলে, আমি কিংবা আপনি কেউই ভাল নেই। এরকম দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় ভাল থাকার কথাও নয়। সব কিছু যেন অনিশ্চিত লাগছে। গোটা পৃথিবীকে এক জোর ধাক্কা দিয়ে গেল শুধুমাত্র এককোষী অনুজীব। করোনা। পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে প্রথম যে দেশে কোরোনার প্রকোপ আছড়ে পড়ে সেটা হল ইতালি। মনে আছে, লেখক ফ্রাঞ্চেস্কা মেলান্দ্রি বাকি দেশগুলোর উদ্দেশে লিখলেন, ‘আমাদের দেশের এখন যা পরিস্থিতি দেখছি, তা-ই আপনাদের ভবিষ্যৎ, শুধু সময়ের অপেক্ষা।’

আপনাদের দেশের মতো আমাদের দেশেও একই অবস্থা। কোনও পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালত সব বন্ধ করে দিয়েছে। আগামী ২৫ এপ্রিল অবধি বন্ধ থাকবে। খবর যা পাচ্ছি, বন্ধ থাকার সময়সীমা আরও বাড়বে। তার কারণ গত কয়েকদিনে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। তবে সব খারাপ খবরের মধ্যে কিছু ভাল খবরও রয়েছে। করোনার মেডিক‌্যাল কিট তৈরি হচ্ছে। দেশে কিছু স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু হয়েছে।

এখন আপনাদের মতো আমিও গৃহবন্দি। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটছে। বই পড়ছি। সিনেমা দেখছি। সৃষ্টিশীল কিছু কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। জনস্বার্থে কিছু কাজও করছি। কিন্তু, সত্যি বলতে কোনও কাজে মন বসাতে পারছি না। খানিকটা সময় পেরতে না পেরতেই মন ছুটে চলে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন মনে হত বাড়িতে থাকা মানে বিলাসিতা। এখন এই বিলাসিতা দমবন্ধ এক পরিবেশের জন্ম দিচ্ছে।

কোনওভাবেই মনঃসংযোগ করতে পারছি না। স্ক্রিপ্ট, বই, সিনেমা কোনও কিছুর সঙ্গে একাত্ম হতে পারছি না।

অখণ্ড অবসর আমার মনে বিরাট এক চাপ সৃষ্টি করছে। কত রকমের চিন্তা গ্রাস করছে। রাস্তার যে সকল কুকুর-বেড়ালগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের জন্য খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। আসলে তারা তো বরাবরই আমাদের মুখাপেক্ষী। ওদের এখন ভীষণ করুণ অবস্থা। লকডাউনের দ্বিতীয় দিন থেকে ওদের খাবারের বন্দোবস্ত শুরু করি। কিন্তু এখন আমারও বাড়ি থেকে বেরনো দুষ্কর। বাড়ির দারোয়ানকে অনেক বলে-কয়ে বিস্কুট আর কিছু শুকনো খাবারদাবার ওদের দিয়ে আসি।

আমার বাড়িতে ছাদবাগান আছে। ভীষণ সবুজ। রোজ ভোরবেলা নিয়ম করে দু’ঘণ্টা ছাদে কাটাই। বাগানের সব গাছপালাকে আদর করি। পানি দিই। পরিচর্যা করি। গাছপালার যত্ন করা আমাদের বংশগত অভ্যাস। মা ভালবাসে, এবং আমার নানাও। দু’জনেই বাগান ভালবাসতেন। নিয়ম করে গাছের পাতা পরিষ্কার থেকে মাটিতে সার দেওয়া, সব করতেন। আমি তাদের থেকেই এটা শিখেছি।

ছাদে উঠলে গাছপালা দেখতে দেখতে যখন আকাশের দিকে তাকাই, কলকাতার কথা খুব মনে পড়ে। কলকাতার আকাশও নিশ্চয়ই এখানকার আকাশের মতো পরিষ্কার। স্বচ্ছ। দূষণমুক্ত।

কলকাতায় আমার যে বাড়ি আছে, তার জানালা দিয়ে আকাশটাকে আরও নীল দেখায়। আর যখন সেই আকাশ কালো করে বৃষ্টির ছাঁট আসে, ভিজে যাই, ওর থেকে সুখকর দৃশ্য বোধ হয় আর কিচ্ছু নেই। দু’দিন আগেই কলকাতায় বৃষ্টি হল। কিন্তু আমি শহরে ছিলাম না। বৃষ্টিতে ভিজতে পারিনি। এতদিনের জন্য কলকাতাকে ছেড়ে কখনও থাকিনি। এও হয়েছে, সকালে মায়ের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে ফ্লাইটে কলকাতায় পৌঁছে লাঞ্চ করেছি।

আমার প্রতিবেশী, ঘরের আসবাবপত্র, বড় জানালার পাশে দেবদারু গাছ, রোজ সকালে সেই গাছে বসে থাকা ঈগলপাখি, সবার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি জানি ওদেরও আমার কথা খুব মনে পড়ে। নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, দেশপ্রিয় পার্কের কথা খুব মনে পড়ে।

আমি কলকাতা থেকে কোনওদিন বিচ্ছিন্ন হতে পারিনি। পারবও না। আমার অর্ধেক মন পড়ে রয়েছে কলকাতায়। বারবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছি, আমাদের ফ্র্যাটারনিটির মানুষজন কেমন আছেন। তারাও নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন, ফোন রাখার আগে বলছেন, “সাবধানে থেকো।”

আমি বুঝতে পারছি একটা বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে। কর্মক্ষেত্রেও সে পরিবর্তন হবে। নতুন সেই পরিস্থিতিতে অনেক কিছু বদলে যাবে। গত এক মাসে প্রকৃতিতেই কত কিছুর পরিবর্তন হয়ে গেল। প্রাকৃতিক পরিবেশও আজ অনেকটা সুস্থ এবং সুন্দর হয়ে উঠেছে। ক’দিন আগে খবর পেলাম, পাঞ্জাব থেকে হিমালয় পর্বত দেখা যাচ্ছে। আমাদের কক্সবাজারের সমুদ্রে নাকি ডলফিন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত কিছু খারাপের মধ্যেও ভাল কিছুও তো রয়েছে।

তাই না? আমার মনে হয়, আমরা মানে ভোগবাদী মানুষ যদি নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিলাসিতা, অভিলাষ খানিকটা কমিয়ে প্রকৃতির প্রতি সহৃদয় হই, তাহলে আমাদের পৃথিবী আরও আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.