ইরান-সৌদি সম্পর্ক : তিক্ততা থেকে সৌহার্দ্যের পথে
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কয়েক বছরের গভীর ভাঙন শেষে ইরান ও সৌদি আরব তাদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে একমত হয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা এবং ইয়েমেন ও সিরিয়া সংঘাতকে উসকে দেয়ার মতো ঘটনার পর দেশ দুটি তাদের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও দূতাবাস খোলার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বি দেশ দুটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বৈঠকে সমঝোতায় পৌঁছানোর পর গতকাল শুক্রবার (১০ মার্চ) এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া ও সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত ইরান ও সৌদি আরব বছরের পর বছর একে অন্যের বিরোধী পক্ষকে সমর্থন দিয়ে আসছিল, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল ‘প্রক্সি যুদ্ধে’।
ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস থেকে কিছু সাম্প্রতিক তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো :
২০১১-আরব বসন্ত
আরব বসন্তের এই সময়ে সৌদি আরব বাহরাইনে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ উসকে দেওয়ার জন্য ইরানকে অভিযুক্ত করে এবং সেখানে এক হাজার সৈন্য পাঠায়। অবশ্য ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
২০১১-সিরিয়া যুদ্ধ
২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দেশ আবার নতুন ছক নিয়ে মুখোমুখি হয়। শিয়া শাসিত ইরান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দেয় এবং সুন্নি বিদ্রোহী দমন করতে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য পাঠায়। অন্যদিকে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সৌদি আরব বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় ও পরে ২০১৪ সালে আইএস দমনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়।
২০১৫-ইয়েমেন যুদ্ধ
২০১৫ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সৌদি আরব দেশটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সরকারকে সমর্থন দেয় ও হুথি বিদ্রোহীদের দমনে কাজ করে। অন্যদিকে ইরান হুথিদের সমর্থন দেয়।
২০১৫-মক্কায় পদদলিত হয়ে মৃত্যু
২০১৫ সালে পবিত্র হজ পালনের সময় পবিত্র নগরী মক্কায় পদদলিত হয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে চারশ’ জনের বেশি ছিলেন ইরানের নাগরিক। ইরান এ ঘটনার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে। দুই দেশের মধ্যে তৈরি হয় উত্তেজনা।
২০১৬-সৌদি আরব সম্পর্ক ছিন্ন করে
পবিত্র নগরী মক্কায় পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনার চার মাস পর সৌদি আরব সরকারের সমালোচক শিয়া ধর্মগুরু নাইমুর আল-নাইমুরের মৃত্যদণ্ড কার্যকর করে। এ ঘটনায় ইরানের রাজধানী তেহরানে বিক্ষোভকারীরা সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায়। এ সময় ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব।
২০১৬- ইরানের হজ বয়কট
একই বছরে ইরান তার দেশের নাগরিকদের হজ পালন স্থগিত ঘোষণা করে। সে সময় সৌদি আরব হজে অংশগ্রহণকারীদের সুবিধায় পার্সিয়ান ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল চালু করে। এ সময় ইরানি নেতা খামেনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি হজ পালনকারীদের নিয়ন্ত্রণে সৌদি আরবের ভূমিকা অবসানের আবেদন জানান।
২০১৭- কাতার অবরোধ
আঞ্চলিক বিবাদের আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের জুন মাসে। এ সময় সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিশর কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে। তাদের অভিযোগ ছিল কাতার ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে ও ‘সন্ত্রাসবাদ’কে সমর্থন দিচ্ছে।
২০১৭- রিয়াদে ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত
সৌদি আরব ২০১৭ সালের নভেম্বরে রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে যেতে থাকা একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করে। সৌদি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে ক্ষেপণাস্ত্রটি ইয়েমেরে হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ছোড়া হয় আর তা সরবরাহ করে ইরান।
২০১৭- লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ
২০১৭ সালের নভেম্বরে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী শাদ হারিরি অনাকাঙ্খিত ও অদ্ভুতভাবে সৌদি রাজধানী রিয়াদ থেকে পদত্যাগ করেন এই বলে যে ইরান হিযবুল্লাহর মাধ্যমে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। পরে অবশ্য তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন। এ ঘটনায় লেবাননে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় যা দেশটির ওপর থেকে ইরানের প্রভাব কমাতে সৌদি চাপ হিসেবে দেখা হয়।
২০১৮-পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা
২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় যার প্রশংসা করে সৌদি আরব ও ইসরায়েল। এ সময় সৌদি যুবরাজ যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যদি তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে তবে তার দেশও এ বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ‘নয়া হিটলার’ হিসেবেও অভিহিত করেন।
২০১৯-সৌদি স্থাপনায় হামলা
এক বছর পর, সৌদি আরব তার দেশের মূল তেল ক্ষেত্রসহ বেশ কিছু হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে। ইরান এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা এই হামলার দায় স্বীকার করে।
২০২০-কাশেম সোলেইমানি হত্যা
ইরানের সামরিক কমান্ডার কাশেম সোলেইমানি যখন মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন তখন সৌদি সরকারি গণমাধ্যম তা উদযাপন করে।
২০২১-ইরান-সৌদি আরব আলোচনা
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বাগদাদের আমন্ত্রণে ইরান ও সৌদি আরবের কর্মকর্তারা সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর প্রথম সরাসরি আলোচনায় বসেন।
২০২২- আরও আলোচনা
গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দুদেশের মধ্যে চার দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এসব আলোচনার মধ্যস্ততাকারী ছিল ইরাক ও ওমান। পঞ্চম দফা আলোচনার পর খোমেনির একজন শীর্ষ উপদেষ্টা পুনরায় দূতাবাস খোলার আহ্বান জানান। এ সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সৌদি আরব সফর করেন।
২০২৩- পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে ঐকমত্য
ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি চীন সফরে গিয়ে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। আর এর পরের মাসেই রিয়াদ ও তেহরান পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।