এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা-৩ অর্জনে ব্যক্তিসচেতনতা ও অংশগ্রহণমূলক আচরণ দরকার

৩১৬

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-র লক্ষ্যমাত্রা-৩ হল সকল বয়সী মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এর আওতায় ১৩টি লক্ষ্যমাত্রা এবং ২৭টি বৈশি^ক সূচক রয়েছে। প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রাই অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। তবুও লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে মাতৃমৃত্যু, নবজাতক ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলা, আত্মহত্যা ও সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হ্রাস করা, সকল প্রকার মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং মাটি, বায়ু, পানি ও ভূমি দূষণ এবং সংক্রমণে ব্যাধি ও মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাসকরণ অন্যতম।

সূচকগুলো অর্জনে সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিরলস কাজ চলছে- এতে সন্দেহ নেই। সরকারের নানামুখী তৎপরতায় ইতিমধ্যে অভীষ্ট সূচকগুলোর মধ্যে বেশকিছু সূচক অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। এসডিজি-৩.১ অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ^ব্যাপী মাতৃমৃত্যুর অনুপাত প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনা। এসডিজি শুরুর বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশে এই অনুপাত ছিল ১৭৮; ২০২০ সালে এসে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৬৩। ৩.২ অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে নবজাতকের মৃত্যুহার ১২-তে এবং অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমপক্ষে ২৫ এ নামিয়ে আনা। বিবিএস-এর মতে, ২০২০ সালে নবজাতকের মৃত্যুহার ১৫ এবং অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুহার হয়েছে ২৫। এইডস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়াও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিবিএস-এর মতে গত দুই বছরে দেশে এইচআইভিতে একজনও মৃত্যুবরণ করেনি। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা পৌঁছানোয় পানিবাহিত রোগসহ অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। চিকিৎসা সহজলভ্য হওয়ায় ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুহারও কমছে ব্যাপক হারে।

তবে সূচক ৩.৪.২-এ উল্লেখিত আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুহার এবং সূচক ৩.৬.১-এ উল্লেখিত সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার কিছুটা উদ্বেগের কারণ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিবিএস-এর হিসাবে সারাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা এবং আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুহার বাড়ছে। এ ধরনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে: দাম্পত্য কলহ, যৌতুক, পিতা-মাতা ও ছেলেমেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য, প্রেম-বিরহ, মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়া, একগুঁয়ে মানসিকতা, ধন-দৌলত হারিয়ে নিঃস্ব, দীর্ঘ রোগ যন্ত্রণা, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, ধর্মীয় রীতিনীতি ও নৈতিক শিক্ষার অভাব। এখন প্রশ্ন হল, শুধু সরকারিভাবে আইন প্রণয়ন করেই কি এসব পারিবারিক ও ব্যক্তি সমস্যার সমাধান করা যাবে?

অন্যদিকে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, গত চার বছরে গড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রতিবছর প্রাণ হারিয়েছেন। এসব সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো হল: ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং, অদক্ষ চালক, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থ চালক, জনসাধরণের মধ্যে ট্রাফিক আইন মেনে চলার প্রতি অনীহা ইত্যাদি। একইভাবে এক্ষেত্রেও সরকারি আইন-কানুনই সমাধানের একমাত্র উপায় নয়।

এছাড়া এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা-৩ এর অন্তর্ভূক্ত আরেকটি বিষয় হল মাদক। মাদক একটি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বিরাট বাঁধা। মাদক সমাজের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তো বটেই নৈতিকতার ভিত্তিও নড়বড়ে করে দেয়। এর থেকে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যদিও সরকার মাদক নির্মূলে কঠোরতা দেখাচ্ছে, তবুও শুধুই কী সরকারের একমাত্র প্রচেষ্টায় মাদকের মতো অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল করা যাবে?

আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুহার, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার ও মাদকের ক্ষেত্রে একইভাবে বলা যায়- এগুলো অবশ্যই সরকারের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সরকার কর্তৃক প্রণীত চমৎকার আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নই সমাধানের একমাত্র পথ নয়। পারিবারিক পরিমন্ডলে যদি নৈতিক সমাধানের চর্চা না থাকে তবে কোনোভাবেই একটি সমাজে মাদক, আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে না।

আবার ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং বায়ু, পানি ও ভূমি দূষণ ও সংক্রমণে ব্যাধি ও মৃত্যুর ২০৩০ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা করা হয়েছে সে ক্ষেত্রেও ব্যক্তির ভূমিকাই মূখ্য।

যেহেতু কাউকে পেছনে রেখে এসডিজি অর্জিত হবে না, তাই উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় লাভ-ক্ষতি কীভাবে সম্পর্কিত এবং এগুলোর ভবিষ্যত নেতিবাচকতার প্রভাব পারিবারিক পরিবেশে সর্বদাই আলোচনা হওয়া দরকার। তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর এখনকার দিনে ব্যক্তিচেতনাই উত্তম প্রতিকার ব্যবস্থা। প্রচলিত ‘প্রিভেনশন ইজ ব্যাটার দ্যান কিউর’ এর স্থলে এখন হয়তো বলা ভালো- ইনডিভিজুয়াল কনসাসনেস ইজ দ্য প্রিসিয়াস মেডিসিন বিওন্ড দ্য গভর্নমেন্ট ইফোর্টস।

পরিশেষে, একটি সুন্দর পৃথিবীর ভবিষ্যত বিনির্মাণে এসডিজি’র প্রত্যেকটি লক্ষ্যমাত্রা পরস্পরের সঙ্গে সুনিবিড়ভাবে সম্পর্কিত; যার একটিকে বাদ রেখে অন্যগুলো কখনোই পুরোপুরি অর্জন সম্ভব হবে না; তাই রাষ্ট্রের পাশাপাশি যেহেতু উল্লেখিত বিষয়গুলো সরাসরি ব্যক্তিসম্পর্কিত সে কারণে প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্বশীল ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।

Comments are closed.