গানের পাখি কবি মতিউর রহমান মল্লিক

0 ৯৬

আবু মালিহা

বাংলা সাহিত্য- সংস্কৃতিতে গানের পাখি হিসেবে খ্যাত কবি মতিউর রহমান মল্লিক। অনুপম সুর সৃষ্টি ও শৈল্পিক দ্যোতনা কবি কণ্ঠে স্বরচিত গানগুলো আরো প্রাণ পেয়েছে। কণ্ঠের কারুকাজ আর নানা ছন্দে সুর তুলে কবি সহজ সরল কথাকেও কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুখরিত করে তুলেছিলেন অন্তর নিঃসৃত ভাবের তরঙ্গে। মনোহারী চিত্তে সে তরঙ্গ আপনা থেকেই বেজে উঠত ঝংকৃত সুরেলায়। তার অন্যবদ্য গান রচনা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন শৈল্পিক চিত্রায়নের মাধ্যমে। কথা, সুর এবং ভাবের তরঙ্গে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন আধুনিক গান রচনায়। বিশেষ করে ইসলামী গান এবং দেশপ্রেমের গভীর মমত্বকে আপন করে ফুটিয়ে তুলেছেন তারই স্বকণ্ঠে। তার গানের ভাব ভাষা ও সুর ছিল অসুন্দরের বিরুদ্ধে, কুসংস্কার ও হীনমন্যতার বিরুদ্ধে। তার গানের সুর ছিল মানবতার জয়গানে। বে-ইনসাফ ও জুলুমের বিরুদ্ধে।

সৌকর্য ও নান্দনিকতার পক্ষে। ঈমানী চেতনাকে বলিষ্ঠতর করার পক্ষে। তার গানের কথা ছিল তৌহিদবাদী চেতনায় সহজ সরল পথের দিকে। যে গানে সত্যিকার ভাবে জাতিকে জাগ্রত করা যায়, সে ধরনের বিপ্লবী ধারার সুশোভিত করা ছিল তার কালজয়ী গানের মূল আবেদন। ব্যথা বেদনাকে আত্মস্থ করে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া ছিল তার গানের অনুরণন।

মহামহিম আল্লাহ তা’য়ালার প্রেমসিক্ত গুণ গান করেছেন কৃতজ্ঞতা চিত্তে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ/ নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া/ পাখির গানে গানে/ হাওয়ার তানে তানে/ ঐ নামেরই পাই মহিমা/ হলে আপন হারা/ ফুলের ঘ্রাণে ঘ্রাণে/ অলির গুঞ্জরণে/ ঐ নামেরই গান শুনে মন/ দেয় যে নীরব সাড়া/…. আকাশ নীলে নীলে/ মুখর ঝিলে ঝিলে/ ঐ নামেরই ঝর্ণাধারা/ আকুল ব্যাকুল পারা।” ইসলামী চেতনাকে উজ্জীবিত করতে আরো লিখেছেন- বাতিলের উৎখাতে বজ্র কঠোর/ আমরা শপথ করেছি/ আজাদীর অন্বেষা সুদীপ্ত সাহসে/ বক্ষে জাপটে ধরেছি/ আমরা থামিনি থামবো না কভু/ আসুক না প্রলয় ঝন্ঝাও তবু/ লাখ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে/ প্রাণে প্রাণে মিনার গড়েছি/ যুগে যুগে আমরা জেহাদ করেছি/ মানিনিতো পরাজয়/ কুফরীর পয়মালে উদ্বত যৌবন/ অগ্নিগিরির বরাভয়/ তিনি তার জীবন দর্শনে যে আদর্শকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন এবং যার তরে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠিত হননি। সেই মহান আদর্শের বার্তাবহ মহান মাবুদের প্রেরিত পুরুষ রসূল (সা:) এর শানে তার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে ভালেবেসে গাইলেনÑ হে রাসূল, আমি বুঝিনা কেন…।

তিনি আল্লাহ প্রেমে উদ্বেল হয়ে আরো গাইলেনÑ এসো আল্লাহকে ভালবাসি দিয়ে মন প্রাণ। আঁকড়ে ধরা আদর্শকে বিজয়ী করতে ক্লান্ত শ্রান্ত মুজাহিদের প্রাণে প্রেরণা যোগাতে তিনি গাইলেন, ‘চলো মুজাহিদ/ চলো চলো/ পথ যে এখনো বাকি’। ‘আজকে আমার প্রাণ সাগরে/ আল্লাহ নামের নূর/ উত্থাল পাথাল ঢেউ তুলেছে/ যেন পাহাড় চূড়/ আজকে আমায় লাগছে ভীষণ ভালো/ নয়ন ভরে অশ্রু দিলো মনের সকল কালো/ মরণ মাঝে জনম নেবার এ কোন নিবিড় সুর হারিয়ে যাবার ডাক শুনেছি উদাস বাউল মাঠে/ ওরে বেহুঁশ ওরে বে-ভোল আয়রে তরা ঘাটে/ ও কোন ছবি আঁকা আকাশ নীলে/ মন মানে না যায় উড়ে সে শাপলা শালুর ঝিলে/ আপনাকে ভাই আপনি পাগল/ আমার

অচিনপুর।”

তিনি আবারও আল্লাহ প্রেমে গাইলেনÑ

আমাকে দাও সে ঈমান/ আল্লাহ মেহেরবান/ যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে/ অসংকোচে/ গায় জীবনের গান/ আল কুরআনের আহ্বানে/ হেরার পথে এসে/ জীবন দেয়ার স্বপ্ন ছিল/ দ্বীনকে ভালবেসে/ যে দিনগুলো মুখর ছিল/ মধুর ছিল/ সতেজ ও দীপ্ত ছিল প্রাণ/ কোন এক শহীদ আমার/ সুনীল আকাশ জুড়ে/ হাজার তারার জ্বালতো প্রদীপ/ স্মৃতির ব্যথায় ঝুরে/ সেদিন যেমন পেরিয়ে গেছি / সকল বাঁধাগুলো/ সকাল সাঝে বাকত লেগে/ পায়ে পথের ধুলো/ আমাকে দাও সে আবেগ/ দাও সে ইমান/ প্রভু হে রহিম রহমান॥

রসুল প্রেমে তিনি আরও গাইলেনÑ সে কোন বন্ধু বলো বেশি বিশ্বস্ত/ কার কাছে মন খুলে দেয়া যায়/ কার কাছে সব কথা বলা যায়/ হওয়া যায় বেশি আশ্বস্ত/ তার নাম আহমদ বড় বিশ্বস্ত/ যে জন কখনো ব্যথা দিতে জানে না/ যে জন শুধু মুছে দেয় বেদনা/ হৃদয়ের হাহাকার আপন করে নিতে চায়/ কার বুক এত প্রশস্ত/ তার নাম আহমদ বড় বিশ্বস্ত/

 

ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশে তিনি অনেক কবিতা, গান লিখেছেন। পুরো জীবনটাকে তিনি ইসলামী আন্দোলনসহ সামাজিক সংস্কৃতি বা অঙ্গনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে কবিতার বইÑ আবর্তিত তৃণলতা, অনবরত বৃক্ষের গান, নিষণ্ন পাখির নীড়ে, তোমার ভাষার তীক্ষè ছোরা।

* গানের বই- ঝংকার, যতো গান গেয়েছি, প্রাণের ভেতরে প্রাণ।

* প্রবন্ধের বই- মহানবী (সা.) ও মানবতাবাদ।

* ছড়ার বই- রঙিন মেঘের পালকি, নতুন চাঁদের আলো।

প্রতিটি গল্প, কবিতা এবং গানে ছিল উজ্জীবিত জীবনের প্রত্যাশা। সংস্কৃতির লালন ও রূপায়ণে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল তার জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য। জীবনের প্রতিটি বাঁকেই ছিল রসূল প্রেমের অনুপম প্রকাশ।

বহু গান আল্লাহ ও রাসূল (সা:) কে ভালবেসে লিখেছেন, যা মানুষের হৃদয় কন্দরে নাড়া দিয়ে যায়। ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে নুয়ে পড়ে মহান মাবুদের দরবারে এবং তাঁর রাসূলকে ভালবেসে আদর্শ ধরে আকড়ে থাকে জীবনভর। বাক্য প্রতিভার এমন ধারার কবি নজরুল, ফররুখের পরে সাধারণত আর আমরা কাউকে পাইনি। যার প্রতিটি ক্ষণই ছিল আদর্শের মানদন্ডে নিজেকে সমর্পিত করা এবং জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা।

মানবতার মুক্তি লক্ষে তার গান ও সুর কালজয়ী ধারার প্রেরণা যোগায়।

 

সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, সাহিত্যপাতা

Leave A Reply

Your email address will not be published.