ফয়সাল আজম অপু : চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সময়ের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম গ্রামবাংলার জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি আজ বিলুপ্তির পথে। নতুন নতুন প্রযুক্তির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটছে, পথে-প্রান্তরে হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের এই ঐতিহ্য।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন হিসেবে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। গ্রামবাংলায় গরুর গাড়িই ছিল যোগাযোগের একমাত্র বাহন। সারা দেশের ন্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে কালের পরিক্রমায় আধুনিকতার স্পর্শে ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি এখন শুধুই অতীতের স্মৃতি। গ্রামগঞ্জে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে বয়ে চলা গরুর গাড়ি এখন আর চোখে পড়ে না।
মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু-একটি গরুর গাড়ি চোঁখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলে মেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলে মেয়েরাও গরুর গাড়ি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়।
গরুর গাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। নব্যপ্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানুষ এই বাহনটি ব্যবহার করে আসছে। হরপ্পা সভ্যতাতেও যে গরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল তার সপক্ষে প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানেও নানা অঞ্চল থেকে এক অক্ষ বিশিষ্ট চাকাওলা নানা খেলনা পাওয়া গেছে।
এগুলো থেকে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিস্টজন্মের ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে
“তোমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে” গান শুনলে অগোচরেই চোখে ভাসে মেঠো পথের ধারে ভাওয়াইয়া সুরে গাড়িয়াল ভাইয়ের গরুর গাড়ি। যদিও আজ আর চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি। গ্রামগঞ্জে রাত-দুপুরে বর-কনে নিয়ে, ঘন অন্ধকারে বা জ্যো¯œার আলোয় আঁকাবাঁকা মেঠো পথে গাড়িয়াল গরুর গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিতো। একদিকে গাড়িয়ালের গানের সুর আর অপরদিকে কনের কান্নার সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।
এক সময় উত্তরাঞ্চলের পল্লী এলাকার জনপ্রিয় বাহন ছিল গরুর গাড়ি। বিশেষ করে এই জনপদে কৃষি ফসল ও মানুষ বহনের জনপ্রিয় বাহন ছিল গরুর গাড়ি। যুগের পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এই বাহন।
বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযানের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তাই এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এখন মানুষ বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরি, নসিমন-করিমনসহ বিভিন্ন মালগাড়ি ব্যবহার করছে। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যান।
ফলে গ্রামাঞ্চলেও আর চোখে পড়ে না গরুর গাড়ি। অথচ গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো, এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ফলে ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতিও করে না। এটি পরিবেশবান্ধব একটি যানবাহন। আবার ধীর গতির কারণে এতে তেমন কোনো দুর্ঘটনারও আশংকা থাকে না। অথচ যুগের পরিবর্তনে আমাদের প্রিয় এই গরুরগাড়ি প্রচলন আজ হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গর্ভে।
আজকাল শহরের সঙ্গে গ্রামেও লেগেছে আধুনিকতার ছোয়া। তবে হঠাৎ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র বিশ্বরোড মোড়ে শুক্রবার (২৫ জুন) বিকালে ঐতিহ্যবাহী যানবাহন গরুর গাড়ির দেখা মিলে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুরহাট-ব্যাহারাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন,আমার একটা গরুর গাড়ি ছিল। ধান, চাল, কুড়া, খৈলসহ মালামাল সহ মানুষ আনা নেওয়ার জন্য গরু গাড়ি চালাতাম। তবে আজ প্রায় ২০/২৫ বছর থেকে এটি বন্ধ। আধুনিক সকল যানবাহন আসায় এটি এখন আর চলে না। কেউ আর ভাড়া নিতে চাই না।
জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের চকভবানীপুর-দেবত্তর গ্রামের কয়েকজন বলেন,২০/২৫ আগেও আশেপাশের গ্রামের ৫০/৬০টি পরিবার গরুর গাড়ির চাকা তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সেদিন কোথায় গেলো? তখন দলবেঁধে গরুর গাড়ির চাকা বিক্রির জন্য নিয়ে যেত নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর,দিনাজপুর সহ বিভিন্ন জেলায়।
Comments are closed.