দুর্গাপুর প্রতিনিধি: নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ জনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে এমন সন্দেহ থাকলেও রোগ সনাক্ত করার আগেই দু’দিনের ব্যবধানে মারা যায় একই দম্পতির দুই শিশু। এ নিয়ে দুই শিশুর পরিবারে চলছে শুধুই আহাজারি। শোকস্তব্ধ পুরো চুনিয়াপাড়া গ্রামবাসী। আশেপাশের গ্রামেও চলছে শোকের মাতম। তবে এখনো চিকিৎসকরা নিশ্চিত করতে পারেননি মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য। মারা যাওয়া দুই শিশুর মধ্যে মুনতাহা মারিশার বয়স প্রায় দুই বছর। আর মুফতাউল মাশিয়ার বয়স প্রায় ৫ বছর। বাবা মনজুর রহমানের সাথে তারাও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারেই থাকতেন।
রোববার দুপুরে সরেজমিনে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মারা যাওয়া দুই শিশুর পরিবারের স্বজনদের আহাজারি। বাধ ভাঙ্গা কান্নায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন শোকসন্তপ্ত পরিবারের স্বজনরা। নানা ভাবে চেষ্টা করেও তাদের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। আশেপাশের গ্রামের অসংখ্য নারী পুরুষ ভিড় জমিয়েছেন চুনিয়াপাড়া গ্রামে। সবার চোখের কোণেই পানি দেখা গেছে। শান্তনা দেবার ভাষাটাও হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ।
জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, জ্বর-বমি থাকলেও রোগ সনাক্ত করার প্রয়োজনীয় সময় পাননি চিকিৎসকরা। দু’দিনের ব্যবধানে একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যুর মতো আকস্মিক এ ঘটনায় পুরো গ্রামে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন সহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনজুর রহমান ও পলি খাতুনের চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, মনজুর রহমান রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক। তার স্ত্রী পলি খাতুন গৃহিণী। তাদের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া গ্রামে হলেও তারা রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সারদায় ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারেই থাকতেন। দুই সন্তানকে হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওই দুই শিশুর বাবা-মাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শনিবার বিকেল ৫টার দিকে মারা যায় মাশিয়া। আর গত বুধবার একই লক্ষণ নিয়ে মারা যায় ছোট বোন মারিশা। বাবা–মা এখনো হাসপাতালেই অবস্থান করছেন। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখানে তাদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। শনিবার বিকেলে স্বজনদের মাধ্যমে মাশিয়ার মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হয়। সন্ধ্যার পরে দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ দাফন করা হয়। গত বুধবার রাতে ছোট মেয়ে মারিশাকেও একই স্থানে দাফন করা হয়েছে।
শিশু দু’টির স্বজনদের বরাত দিয়ে প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম জানান, গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে কোয়ার্টারের কাজের বুয়া কলেজ ক্যাম্পাসের গাছ থেকে বরই কুড়িয়ে এনে দুই শিশুকে খেতে দিয়েছিলেন। না ধুয়েই ওই বরই খেয়েছিল মারিশা আর মাশিয়া। পরদিন বেলা ১১টার দিকে মারিশার জ্বর আসে। বারবার পানি খাচ্ছিল। দুপুরের পর শুরু হয় বমি। রাজশাহীর সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। এরপর শুক্রবার সকাল থেকে মাশিয়ারও জ্বর আসে। শুরু হয় বমি। তাকে প্রথমে চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে রাজশাহী সিএমএইচে নেওয়া হয়। রাতে মাশিয়ারও পুরো শরীরে ছোপ ছোপ কাল দাগ উঠতে শুরু করে। তা দেখে সিএমএইচের চিকিৎসকেরা মাশিয়াকে রামেক হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। রাত ৯টায় তাকে রামেক হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে দ্রুত আইসিইউতে নেন। শনিবার বিকেলে মাশিয়াও মারা যায়।
রামেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে বাচ্চা দুইটা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। যদিও তাদের বাবা-মা জানিয়েছেন, তারা খেজুর রস খায়নি। তবে না ধুয়ে বরই খেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এটা নিপাহ ভাইরাস হতে পারে। আবার অন্য কোনো ভাইরাসও হতে পারে। সেটা আসলেই কি তা জানতে হাসপাতালে মারা যাওয়া মারিশা আর তার বাবা-মায়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রোববার রিপোর্ট হাতে পাওয়া যাবে। তখন মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’