দীপক কুমার সরকার, বগুড়া:
‘‘রুক্ষ শীতের শূন্যতা শেষ- প্রান ফিরেছে ধরায়,
অনুভূতির রঙ্গিন ফেরি সর্বাঙ্গে জড়ায়।
গুনগুনিয়ে ভ্রমর চলে, মৌমাছিও আছে,
সরিষা ক্ষেতে মধু পাবে, মুকুল আমের গাছে।
বউ কথা কও ডাকছে পাখি, কোকিল ধরে গান।
হিয়ায় আমার বিধলো বুঝি, মদন দেবের বান!’’
এমন কাব্যিক কথাগুলোয় মনে করিয়ে দেয় আজ বুঝি হৃদয়ে ফাগুনের হিমেল হাওয়ায় লেগেছে। বাংলা দিনপুঞ্জির পরিক্রমা অনুযায়ী আবারও এসেছে ফাগুন, এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতির চারপাশে সুমধুর সুর, মিষ্টি কলতান। প্রকৃতি মেলেছে রঙিন পাখনা। পত্র-পল্লব, তরুলতা ও বৃক্ষরাজিতে সবুজ হাসি। ফুল-পাখি-পতঙ্গের মিলনমেলায় ভাসছে প্রকৃতি-প্রান্তর। সর্বত্র উৎসবের রঙ। বসন্তের ছোঁয়ায় মেতেছে প্রাণ। শীতের শুষ্কতা মুছে দখিন হাওয়ায় ভর করে এসেছে বসন্ত। প্রকৃতি তাই উদ্বেলিত নবযৌবনের নবরূপ পাওয়ার আশায়। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানাচ্ছে শিমুল, পলাশ, কনকচাঁপা, রক্তকাঞ্চন, বেলী, কৃষ্ণচূড়ার দল। ঋতুপতিকে কাছে পেয়ে পাতাঝরা গাছটি ব্যস্ত নিজেকে নতুন করে সাজাতে। কচিপাতার সবুজ আঁচলে আবৃত হতে শূন্য গাছটি তার জীর্ণ পাতাগুলোকে তাড়া দিচ্ছে নিচ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। বাংলার পথ-প্রান্তর শোভিত আজ লাল-লিলিমায়। ফাগুনের রঙে রঙিন হতে এসেছে কোকিল, কৃষ্ণচূড়ার ডালে। কুহু কুহু সুরের মূর্ছনায় ভাসাচ্ছে প্রকৃতি।
১৪ ফেব্রুয়ারি বাঙালির পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের স্বরসতী পূজা ও ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জমজমাট হয়ে উঠেছে বগুড়ার ফুল বাজার। এই তিনটি দিবসকে ঘিরে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইতিমধ্যে বগুড়ার ফুল ব্যবসায়ীরা বগুড়া, যশোর, ঢাকা ও টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন ফুলের মোকাম থেকে ফুল সংগ্রহ শুরু করেছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশেষ তিনটি দিবস উপলক্ষে প্রতিটি ফুলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বগুড়ার ফুল মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, বিশেষ তিনটি দিবসকে ঘিরে বগুড়ায় এখন জমজমাট ফুল বাজার। আগে থেকেই ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে ফুল দোকানে ভিড় করছেন তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সী মানুষরা।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বগুড়ার ফুল মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এ মাসে প্রায় কোটি টাকার ফুল বিক্রি করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে সারা বছর বগুড়ার বাজারে প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়ে থাকে। এর মধ্যে খুচরা দোকানে প্রায় ২ কোটি টাকা আর পাইকারি বাজারে ১ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়।
দিন যতই যাচ্ছে, বগুড়ায় ফুলের চাহিদা বেড়েই চলছে। বিভিন্ন দিবসে, বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফুলের চাহিদা রয়েছে। তবে ডিসেম্বর থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। বিক্রিও বেড়ে যায়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো আর ফুল নষ্ট হয় না। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পয়লা ফাল্গুন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বগুড়ায় ফুলের চাহিদা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে।
বগুড়া শহীদ খোকন পার্ক এলাকার ফুল ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক তার ব্যবসায়িক জীবনের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানান, ফুলের বাজার খুব ধীর গতিতে চলে। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে তেমন বেচাকেনা না হলেও সাধারণত বৃহস্পতি ও শুক্রবারে ফুল একটু বেশী বিক্রি হয় । এছাড়াও নববর্ষ, জাতীয় দিবসগুলো সহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুল বিক্রি হলেও সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয় বসন্ত ও ভালবাসা দিবসে।
তবে এবার সেই উৎসবের সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে স্বরসতী পূজা। এসব উৎসবে গোলাপের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। লাল হলুদ গোলাপের দাম ৫০টাকা। বিভিন্ন রঙের থাই গোলাপ থেকে ১শ থেকে ১২০ পর্যন্ত, গ্লাডিওলাস ২০, রজনীগন্ধা ১৫-১৮, টিউলিপ ফুল ১২০ টাকা, জারবেরা ১৫ থেকে ২৫, গাদা প্রতিটা ২ টাকা, গাজরা ১০০ টাকা, গাঁদা ফুল প্রতি হাজার এক হাজার টাকা, ফুলের তোরা ৪শ’-৫শ’, মাথার ব্যান্ড ১২০-১৫০টাকা করে বিক্রির টার্গেট। বিশ্ব ভালোবাসা, পহেলা ফাল্গুন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিটি ফুল ১০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে।
তবে ফুলের চাহিদা মেটাতে যশোরের গদখালি এলাকার ফুলের ওপর ব্যবসায়ীরা নির্ভর করতে হতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে বগুড়ায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষে এগিয়ে আছে সদর উপজেলা। এ ছাড়াও জেলার শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর ও সোনাতলা উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করা হচ্ছে। এ উপজেলাগুলোতে ফুল চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন শতাধিক যুবক।
মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন বগুড়ার শহীদ খোকন পার্ক সংলগ্ন ফুল বাজার ও শেরপুরের মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বিশেষ এ দিবসগুলো ঘিরে বগুড়ায় এখন জমজমাট ফুল বাজার। আগে থেকেই ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে ফুল দোকানে ভিড় করছেন তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সী মানুষ।
বগুড়া শহরের চেলোপাড়া(বৌ বাজার) এলাকার সুব্রত ঘোষ জানান, বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবসে ফুলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। ফুলবাজারে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফুল কিনলাম।
ফুল কিনতে আসা সুমাইয়া পারভীন জানান, আমি আমার স্বামী এবং সন্তানদেরকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ফুল মার্কেটে ফুল কিনতে এসেছি। তবে দেখলাম গত বছরের তুলনায় এবার ফুলের দাম অনেক বেশি। তবুও কিছু ফুল কিনলাম!
বগুড়া জেলা ফুল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও করতোয়া ফুলঘরের মালিক লক্ষণ দাস বলেন, পাইকারিতে ফুলের বাজার খুব চড়া। ফুল কাঁচামাল হওয়ায় সারাবছর প্রতিটি দোকানির লোকসান গুণতে হয়। বিভিন্ন দিবসগুলোতে সেই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুশিয়ে তোলেন ব্যবসায়ীরা। বসন্ত, ভালবাসা দিবস ও সরস্বতী পূজায় ২৬ থেকে ৩০ লাখ টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট।
এছাড়াও সামনে আছে ২১ ফেব্রুয়ারি। এই দিবসগুলোতে সব মিলিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকার ব্যবসা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই টার্গেট নিয়েই প্রতিটি দোকানে গোলাপসহ বিভিন্ন ধরণের ফুলের যোগান বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এই দিনে পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভালোবাসার মানুষে পরিপূর্ণ থাকে। ভালোবাসা দিবসের এই দিনে প্রিয়জনকে সবাই ফুল ও বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়ে থাকে। লাল-হলুদ-বেগুনি গোলাপ, ডালিয়া, ডায়ানথাস, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, জারবেরা, গাঁদাসহ নানা ফুল শোভা পাবে মানুষের হাতে, কিশোরী-তরুণীদের খোঁপায় কিংবা মাথায়। সাথে পহেলা ফাগুনে বসন্ত উৎসবকে ঘিরে নিজে রাঙিয়ে আনন্দে উল্লাসে মেতে উঠেছে সংস্কৃতি প্রেমীরা।