দীপক কুমার সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: পৃথিবীতে অশুভ, অত্যাচারী, হীনমন্য, সন্ত্রাসী ও পশুশক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তি ও ন্যায়ের বিজয়, সাধু, সৎ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য অভয়বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হন দেবী দুর্গতিনাশিনী।
পাপাচ্ছন্ন পৃথিবীতে প্রতি বছরই সমগ্র জগতের কল্যাণ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জীবের সুখ ও শান্তি কামনায় প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপিত হতে যাচ্ছে। দেবী দূর্গা আগমনীতে রোগ-ব্যাধি, জড়া মুক্তে সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে এমনটাই প্রার্থনা হবে প্রতিটি পূজা মন্ডপগুলোতে।
বগুড়া জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর বগুড়া জেলায় ৬৯৩টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে বগুড়া সদর উপজেলায় ১১৭টি মন্ডপে। এছাড়া শেরপুর উপজেলায় ৯৪টি মন্ডপে, গাবতলীতে ৭৪টি, আদমদীঘিতে ৬৫টি, শিবগঞ্জে ৬০টি, শাজাহানপুরে ৫০টি, সোনাতলায় ৪৯টি, নন্দীগ্রামে ৪৫টি, দুপচাঁচিয়ায় ৪২টি, ধুনটে ৩৯টি, কাহালুতে ৩৩টি ও সারিয়াকান্দি ২৩টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রতিটি পূজা মন্ডপে ৫’শ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসন জানিয়েছেন। এ ছাড়াও জেলার ১২টি উপজেলায় এবার ৬৯৩ টি পূজা মন্ডপে পূজা উদযাপনকে ঘিরে বগুড়া জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
সরেজমিনে বগুড়া শহরের চেলোপাড়া নববৃন্দাবন হরিবাসর মন্দির গিয়ে দেখা যায়, নিপূঁণ হাতে কাঁদামাটি, খড়, বাঁশ, সুতলি দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হয়ে বেশ কয়েকদিন আগেই। এখন শুধু দেবী দুর্গার অনিন্দ্য সুন্দর রূপ দিতে দম ফেলার সময় নেই তাদের। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বিভিন্ন মন্ডপে শিল্পীরা প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করছেন জোরেশোরে।
ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরদের নিপুঁণ হাতের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলছেন দেবী দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশসহ নানা প্রতিমা। কোথাও কোথাও এরইমধ্যে শেষ হয়েছে রঙ তুলির কাজ। ২০ অক্টোবর পূজা শুরু তাইতো শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা।
বগুড়া শেরপুরে ঘোষপাড়ায় প্রতিমা তৈরির কারিগর রামচন্দ্র রাজবংশী বলেন, দুর্গাপূজার বোধনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে আর মাত্র ১দিন বাকি। এবার ৭টি প্রতিমার অর্ডার পেয়েছেন। এ পুরো মাস দম ফেরানোর ও সুযোগ কম আমাদের। তবে বছরের অন্য সময় মাটির কাজ থাকে না।
এ এক দেড় মাসের আয় দিয়ে পুরো বছরের সংসার চলে। তবে কারিগররা বলেন, ‘আগের মত তারা পারিশ্রমিক নেই যে কারণে আমাদের এ পেশায় থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে।’ প্রতিমা শিল্পীরা অনেকটা আক্ষেপের সাথে বলেন, নিত্যপণ্যের সাথে খড়, মাটিসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ায় প্রতিমা তৈরী করে খুব একটা বাড়তি লাভ হচ্ছেনা। তবে এবার ২০ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতিমা তৈরী করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় দেবী বোধনের মধ্য দিয়ে দেবীর আগমন ধ্বনি অনুরণিত হবে। ২০ অক্টোবর শুক্রবার ষষ্ঠীতে দশভুজা দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসনের মাধ্যমে শুরু হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে পরবর্তী পাঁচ দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ আপামর বাঙালি মেতে থাকবে দুর্গোৎসবে। আগামী ২৪ অক্টোবর মঙ্গলবার দশমীতে বিসর্জনের মাধ্যমে দেবী বিদায় নেবেন মর্ত্য থেকে।
হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস ও বাংলা পঞ্জিকা মতে, এ বছর দেবী দুর্গা দূর কৈলাশ ছেড়ে পিতৃৃগৃহ মর্ত্যধামে আগমন ও কৈলাশে ফিরে যাবেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চড়ে। আগমন ও গমনের অর্থ সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ছত্রভঙ্গের ইঙ্গিত দেয়। তবে সমস্ত অপশক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভশক্তির বিজয় ঘটবে। সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে দেশ-এমনটাই প্রত্যাশা।
বগুড়া জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দুনাথ রায় নির্মল জানান, জেলায় এবার ৬৯৩টি ম-পে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। জেলা ও উপজেলা পূজা উদযাপনের নেতৃবৃন্দ সব সময় সজাগ রয়েছে। এবার সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি।
বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. গোলাম কিবরিয়া জানান, এ বছরও ৬৯৩টি মন্ডপের তালিকা আমার কাছে এসেছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলার প্রতিটি মন্ডপের বিপরীতে এবারও ৫’শ কেজি করে সরকারি চাল বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে।
বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জানান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নির্বিঘেœ উৎসবমূখর পরিবেশে পূজা সম্পন্ন করতে সকল প্রস্তুতি গ্রহন করেছে জেলা পুলিশ। পূজা মন্ডপে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় থাকবে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়। কেউ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে। বিপুল সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি র্যাব সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন। গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে।
নিরাপত্তার জন্য মন্ডপে মন্ডপে বসানো হবে সিসিটিভি ক্যামেরা। এছাড়াও প্রতিটা মন্দিরে আনসার বাহিনীর সদস্য সার্বক্ষণিক থাকবে। তবে পূজার আগে, পূজা চলাকালিন ও প্রতিমা বিসর্জনের সময় তিনভাগে ভাগ হয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। পূজায় মাদকের অবাধ বিস্তাররোধে কঠোর অবস্থানে থাকবে পুলিশ তিনি আরও দাবী করেন।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বগুড়ার সবকটি উপজেলায় শান্তিপূর্ণ ও উৎসব মুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গাপূজা সম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিমা তৈরির সময়ে যাতে প্রতিমার কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য আয়োজক কমিটিকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।