সোনাদিঘীর মোড়
মোজাফফর হোসেন
আল মুকাদ্দিমা আছে?
সেটা আবার কী?
বই।
লেখকের নাম কী?
ইবনে খালদুন।
না, নাই।
আপনারা বেচেন না?
না, আমরা স্কুল-কলেজ ও বিসিএসের গাইড বই বেচি। কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
পুস্তক বিক্রেতা এবার জিজ্ঞেস করলো; এটা কী ধরনের বই? মানে কবিতা, গল্প, উপন্যাস না অন্য কিছু?
ইতিহাস গ্রন্থ।
বিক্রেতা বললেন, এটা আপনি পেতে পারেন পার্করোড ইসলামীয়া বই বিতানে; তারা এই ধরনের বই বিক্রি করেন।
দোকান থেকে বের হয়ে মুস্তাকিম ভাবলো। এই সোনাদিঘীর মোড় নতুন-পুরাতন বই বিক্রির জন্য খ্যাত। এখানে অন্তত ত্রিশ-চল্লিশটি দোকান আছে, যারা বিভিন্ন প্রকৃতির বই বিক্রি করে। বিষয় সেটা নয়; বিষয়টি হলো পুস্তক বিক্রেতার বয়স প্রায় সত্তর বছরের কাছাকাছি। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি। লেখা-পড়াও জানে; অথচ এই লোক আল-মুকাদ্দিমা বা ইবনে খালদুনের নামই শোনেন নি কখনো।
মুস্তাকিম ভাবলো। পুস্তক বিক্রেতা কেনো, এদেশের অধিকাংশ শিক্ষকই হয়তো আল মুকাদ্দিমার সাথে পরিচিত নয়। এমন কী মুস্তাকিম নিজেও এক মাস পূর্বেও এই বইয়ের নাম জানতো না। যদি না তার শ্রদ্ধেয় এক বড় ভাই সেদিন কথা প্রসঙ্গে না বলতো। অথচ মুস্তাকিম রসায়নে এমএসসি সম্মান পাশ করা গোল্ড মেডেল পাওয়া শিক্ষার্থী ছিল।
মুস্তাকিম ইসলামীয়া বই বিতানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বইয়ের বেশ বড়সরো দোকান। থরে থরে বই সাজানো। কুরআন, হাদীস, বুখারী, তিরমিযি, উসূলে ফেকাহ, বেহেস্তী জেওর। দূর থেকেই চোখে পড়ছে। দোকানের সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছে, বেচা-বিক্রি ভালো। ক্রেতার লাইন আছে। মুস্তাকিম ভাবলো, ভিড় কমলে সামনে যাবে। হঠাৎ তার মনে হলো; এতগুলো বইয়ের দোকান এই সোনাদিঘীর মোড়ে। তার মধ্যে একটি দোকানের নাম ইসলামীয়া বই বিতান। বাকি দোকাগুলোর সাথে ইসলামের কী কোনো সম্পর্ক নাই? কিংবা এই দোকানটির নামই বা কেনো ইসলামীয়া দিতে হলো? মুস্তাকিমের মাথায় অদ্ভুত এক চিন্তা খেলা করলো। মুস্তাকিমের মনে হতে থাকলো; পাড়ার একশ ঘর বসতির মধ্যে একঘর মুসলিম বসতির মতো। এতগুলো দোকানের মধ্যে মাত্র একটি দোকান ইসলামী বই বিক্রি করে। অথচ গোটা শহরের নব্বই ভাগ মানুষই মুসলমান। সব দোকানেই তো ইসলামী বইয়ের সমাহার থাকা দরকার ছিল! মুস্তাকিমের মনে আশঙ্কা দেখা দিলো। তাহলে কী মুসলমান এ শহরে এক ঘরে হয়ে গেলো? ব্যাপারটি নিজ দেশে পরবাসীর মতো হলো না? বিষয়টি মুস্তাকিমকে গভীর ভাবাবেগে ফেললো। সত্যি তো! বিষয়টি এমনই হলো; মুসলিম পাড়াতেই মাত্র একঘর মুসলিম। অনুভূতিটি মুস্তাকিমের কাছে ভয়ঙ্কর ঠেকলো।
ভিড় কমেছে। মুস্তাকিম পুস্তক বিত্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো আল মুকাদ্দিমা আছে কি না। বিক্রেতা বললো- এক সেট ছিল। পনের-বিশ দিন হলো বিক্রি হয়ে গেছে; আর অর্ডার দেওয়া হয়নি। খুব বেশি টানে না তো তাই।
শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের মুখে আল মুকাদ্দিমার বর্ণনা শুনে মুস্তাকিমের মনে হয়েছিল বইটি পড়া দরকার। মুস্তাকিমের পড়াশুনা বিজ্ঞানে। ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আগ্রহ কম ছিল। সম্প্রতি মুস্তাকিম নিজের মধ্যে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি এক ধরনের টান লক্ষ্য করছে। মুস্তাকিমের মনে হচ্ছে শুধু বিজ্ঞান পড়ে মনের খোড়াক মিটছে না। বিজ্ঞানের বাইরের জগৎ নিয়েও তার অভিজ্ঞতা দরকার।
মুস্তাকিম ভাবলো জগত-সংসারের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান রাখা জরুরি। সে কখন যেন শুনেছিল জ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ হলো পবিত্র কুরআন। কিন্তু সে তো কুরআন পড়তে জানে না! এই প্রথম মুস্তাকিমের মনে হলো; কুরআন পড়তে না শিখে সে তো মারাত্মক ভুল করেছে। এবার মুস্তাকিম নিজের কাছেই নিজেকে অশিক্ষিত মূর্খ মনে করলো।
এসব ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো।
পুস্তক বিক্রেতা লক্ষ করলো মুস্তাকিম দাঁড়িয়েই আছে। সে বললো; আল মুকাদ্দিমা শেষ হয়ে গেছে, আগামী মাসে আসেন, পেতে পারেন।
মুস্তাকিম পুস্তক বিক্রেতাকে ইঙ্গিত করে বাংলা অনুবাদ কুরআনের এক কপি দিতে বললেন ॥
কপি: দৈনিক সংগ্রাম,
- সাহিত্য