কোভিড রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে চীনের হাসপাতাল

২০১
সাংহাইয়ের অন্যতম বৃহৎ হাসপাতাল দংহাই এল্ডারলি কেয়ার হাসপাতাল। ছবি : সংগৃহীত

সাংহাই চীনের সবচেয়ে বড় শহর। বর্তমানে কোভিড সংক্রমণের উদ্‌বেগজনক হার মোকাবিলা করতে প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শহরটি। এ থেকে চীনের শহরটিতে করোনার প্রাদুর্ভাবের মাত্রা আন্দাজ করা যায়। খবর বিবিসির।

তবে, সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সাংহাইয়ে কোভিডে নতুন কোনো মৃত্যুর ঘোষণা আসেনি।

সাংহাইয়ের পূর্বাঞ্চলীয় পুদং এলাকায় দংহাই এল্ডারলি কেয়ার হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা হাসপাতালের ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন। তাঁরা জানান, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডজনখানেক বয়স্ক রোগীর সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন। ওই রোগীদের মধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন।

একজন নার্স বিবিসিকে বলেন, তিন সপ্তাহ আগে প্রথম এক জনের কোভিড শনাক্ত হয়। এর পর ওই এলাকা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তখন থেকে পৌরকেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ দলগুলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

গত সপ্তাহে এল্ডারলি কেয়ার হাসপাতালের এক পরিচর্যাকর্মী জানান, তিনি একজন রোগীকে মারা যেতে দেখেছেন এবং তাঁর এক সহকর্মীরও এমন মৃত রোগী দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে, হাসপাতালের কর্মীরা জানিয়েছেন—এসব রোগী কোভিডে মারা গিয়েছিলেন কি না, তা বলা কঠিন। কারণ, তখন বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ছিল।

এল্ডারলি কেয়ার হাসপাতালের একজন সেবিকা বিবিসিকে জানিয়েছেন, কোয়ারেন্টিনে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে তিনি কাজ সেরে হাসপাতালেই ঘুমাতেন। তিনি আরও জানান, তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে জানিয়েছিলেন—প্রতিদিন নতুন নতুন আক্রান্ত রোগী আসায় কোভিড পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছিল।

হাসপাতালের ওই সেবিকা দাবি করেন—সাংহাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে দুজন মেডিকেল স্টাফ ও বিশেষজ্ঞ পাঠানো হয়েছিল, তাঁরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি আরও জানান, সেখানে আরও শত শত লোক কোভিডে সংক্রমিত হয়েছিল।

ওই নার্স বিবিসিকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা স্বাভাবিক কাজ করতে থাকি। কিন্তু, পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতিটি বিভাগকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। এবং ম্যানেজার আমাদের সে সময় জানান যে, বাস্তব পরিস্থিতি খুব খারাপ।’ তিনি আরও বলেন, এমন অনেক রোগীও ছিলেন, যাঁরা মাস্ক পরতে চাননি।

এ সপ্তাহে হাসপাতালে কর্মরত একজন পরিচর্যাকর্মী বলেন, তিনি যখন আসেন, তখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে হাসপাতালের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল।

বিবিসিতে প্রকাশিত একাধিক ভিডিওতেও দেখতে পাওয়া যায়, একটি বাড়ির একপাশে হলওয়েতে উপচে পড়া বর্জ্যদানি এবং আবর্জনায় ভরা ব্যাগ পড়ে আছে।

এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অভিযোগ করেছেন—তাঁরা প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

এক ব্যক্তি বিবিসিকে জানান, তাঁর দাদি হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় তাঁর শারীরিক অবস্থার তথ্য পেতে খুব কষ্ট হয়েছে। প্রথমদিকে তিনি একজন পরিচর্যাকর্মীর কাছ থেকে খোঁজ নিতেন। কিন্তু, পরে কোভিড পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ আসায় তা আরও দুরূহ হয়ে পড়ে। আর, কোয়ারেন্টিনের পর পরিচর্যাকর্মীর কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ওই ব্যক্তি জানান, গত সোমবার লকডাউন শুরুর পর থেকেই তিনি তাঁর দাদির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারছেন না। এ ছাড়া তিনি ফোন করলে হাসপাতালের কর্মীরা তাঁর দাদিকে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে বা কোন ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

বিবিসি দংহাই হাসপাতাল, পুদং নিউ ডিস্ট্রিক্ট হেলথ কমিশন ও সাংহাই মিউনিসিপ্যাল কমিশনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু, কেউই সাড়া দেয়নি।

কাছাকাছি একটি শেষকৃত্যানুষ্ঠান কেন্দ্রে বিবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু, ওই কেন্দ্রটি হাসপাতাল থেকে কোনো মৃত রোগী পেয়েছে কি না, তা জানাতে পারেনি। এ ছাড়া সাংহাই ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিসেও মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু সাড়া মেলেনি।

তবে, বারবার গণবিবৃতিতে কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের ঠিকানা উল্লেখ করে সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যদিও তারা নির্দিষ্টভাবে কোনো নাম উল্লেখ করেনি। গত দুই সপ্তাহে কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে হাসপাতালের ঠিকানাটি নয় বার উল্লেখ করা হয়েছে।

মোকাবিলা প্রক্রিয়া

সাংহাইয়ের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যে বর্ধিত চাহিদা মোকাবিলা করছে, তার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

গত বৃহস্পতিবার সাংহাইয়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ৬২ বছর বয়সি এক বৃদ্ধের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ওই ব্যক্তি অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে আরও জরুরি চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরে মারা যান। আর, যে অ্যাম্বুলেন্সকর্মী ওই রোগীকে পরিবহণ সেবা দেননি কিংবা জরুরি শ্বাসযন্ত্র ব্যবহার করতে দেননি, তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার সাংহাই চীনের বৃহত্তম শহর। সেখানে সংক্রমণশীল করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে নয় দিনের লকডাউন জারি রয়েছে।

সাংহাই কর্তৃপক্ষ শহরের পূর্বাংশ বন্ধ করে সেখানকার বাসিন্দাদের সবাইর কোভিড পরীক্ষা করানোর পরিকল্পনা করেছিল। এরপর শহরের পশ্চিম অংশেও লকডাউন আরোপ করা হয়।

আগামী শুক্রবার পুদং খোলার পরিকল্পনা থাকলেও এখনও সেখানে কঠোর বিধিনিষেধ জারি রয়েছে। আর, কোভিড পরীক্ষার বিলম্বিত ফলাফলে বোঝা যাচ্ছে যে, এখনও সেখানকার অনেক এলাকায় লাখ লাখ মানুষ লকডাউনে রয়েছে।

লকডাউন আরোপের এক সপ্তাহ আগে শহরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা দাবি করে আসছিলেন—সাংহাইয়ের মতো চীনের এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরে উহান, জিয়ান ও শেনজেনের মতো লকডাউন জারি করা হবে না।

তবে, কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মা চুনলেই স্বীকার করেছেন—সাংহাই করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

গতকাল মা চুনলেই বলেন, ‘আমাদের সচেতনতা পর্যাপ্ত ছিল না… আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়।’

ব্যর্থতার এমন বিরল প্রকাশ্য স্বীকারোক্তিতে মা চুনলেই আরও বলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে আপনাদের সমালোচনা মাথা পেতে নিচ্ছি। আমরা এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি।’

Comments are closed.