গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে পাখি বাসা তৈরী করে বাচ্চা ফুঁটিয়েছে

0 ৬২১

ইমদাদুল হক,পাইকগাছা ,খুলনা : পাখি বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। পাখি মানুষের পরম বন্ধু। পরিবেশ সুরক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। পাখি আমাদের চার পাশের পরিবেশের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ওদের সাধ্যমত সহায়তা করছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। কিন্তু উপকূলের পাখিরা বিপন্ন। নানা প্রজাতির পাখি ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এর অন্যমত কারণ হচ্ছে এ এলাকার মানুষের পাখি শিকার। তাই পাখির জন্য দরকার নির্ভয় পরিবেশ। পাখির জন্য নিরাপদ প্রজনন ও অভারন্য গড়ে তুলতে কাজ করছে পরিবেশবাদী সংগঠন বনবিবি। এলাকার গাছে গাছে পাখির বাসার জন্য বাঁধা হচ্ছে মাটির পাত্র। এতে পাখি শিকার বন্ধ ও পাখির নির্ভয় পরিবেশে গড়ে উঠছে অভারন্য।

বর্তমান বিশ্বের জলবায়ুর পরির্বতনের ফলে পাখিদেও আবাসস্থল ধ¦ংস হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারনে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উপকুল এলাকায় পাখির আবাসস্থল নিরাপদ রাখা ও বিচারণস্থল সংরক্ষনের কাজ করে যাচ্ছে বনবিবি।

পাখির বাসার জন্য পাইকগাছার বিভিন্ন গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে পাখি বাসা তৈরী করেছে, ডিম পেড়েছে ও বাচ্চা ফুটিয়েছে। এ স্বপ্ন দেখে ছিলেন, পরিবেশবাদী সংগঠন বনবিবির সভাপতি প্রকাশ ঘোষ বিধান। এখন সে স্বপ্ন ধারাবাহিক ভাবে বাস্তবায়ন হতে চলেছে। গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে পাখি বাসা তৈরী করায় সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে ব্যপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া পড়েছে।

উপজেলা বিভিন্ন গাছে গাছে বাঁধা হচ্ছে মাটির পাত্র, ছোট ঝুড়ি ও বাঁশের তৈরী বাসা। আর তাতে পাখিরা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। উপজেলার সরল মেইন সড়কের পাশে বট গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে শালিক বাসা বেঁধেছে, নতুন বাজারের পাশে বকুল ও মেহগুনি বাঁধা মাটির পাত্রে চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছে। গোপালপুর স্কুলের পাশের মেহগুনি গাছে দোয়েল পাখি বাসা বেঁধেছে, বোয়ালিয়া কপোতাক্ষ নদে তীরে বটগাছে দোয়েল পাখি বাসা বেঁধেছে।

প্রকৃতির নিয়মে পাখিরা নির্দিষ্ট সময়ে প্রজননের জন্য বাসা তৈরীর অনুকুল পরিবেশ খুঁজে নেয়। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত পাখিদের প্রজননের সময়। এপ্রিল থেকে বাসা বানাতে শুরু করে পাখি। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি তারা তাদের পছন্দমত গাছের ডাল, পাতা, গাছের গর্তে আবাসস্থল হিসাবে বেঁছে নেয়, যেমন- কাঁক, চিল, ঈগল, বাচপাখি, বড় উঁচু গাছের মগডালে বাসা তৈরী করে। টিয়া, কাটঠুকরা গাছের গর্তে বা গাছের কান্ড ছিদ্র করে বাসা তৈরী করে। মাছরাঙ্গা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি মাটির গর্তে বাসা তৈরী করে। এসব প্রজাতির পাখি মাটির পাত্রে বাসা বাঁধে না। মাটির কলস বা পাত্রের দোয়েল, শালিক, পেঁচা, চড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা প্রজনন করতে বাসা তৈরী করে। মাটির পাত্র আশ্রয়স্থল। পাখি মাটির পাত্রের ভিতরে তারমত করে ছোট ছোট ডাল, খড়খুটা দিয়ে বাসা তৈরী করে।

উপকুলের এ উপজেলায় পাখি সুরক্ষায় আবাসস্থল তৈরীর লক্ষ্যে গাছে মাটির পাত্র বেঁধে দেওয়া অনেকে সহজ ভাবে গ্রহণ করেনি। নানা কুটুক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও শুনতে হয়েছে। প্রথম বছরে গাছে বাঁধা প্রায় সব মাটির পাত্র গুলতি মেরে ও ইট পাথর ছুড়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এমন এক সময় ছিল এ এলাকার শিকারীরা দল বেঁধে পাখি শিকারে মেতে উঠতো। আর শীতকাল আসলে তো পাখি শিকার মহউৎসবে পরিনত হতো। শীত কালে জলাশয় ও ধানক্ষেতে ফাঁদ, জাল, বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করা হতো।

 

সংগঠনটি বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে লিপলেট ও পাখি রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে উদ্ভুদ্ধকরণ সভা করা হয়। এখন এলাকায় প্রায় সকলে পাখি রক্ষা বা আবাসস্থল সংরক্ষনের লক্ষ্যে গাছে মাটির পাত্র বাঁধায় সহযোগীতা করছে। কেউ যাতে মাটির পাত্র ভেঙ্গে না দেয় তাও খেয়াল রাখে। পাখি যে মানুষের পরম বন্ধু তা তারা অনুধাবন করতে পেরেছে। পাখি পৃথিবীর ৮০ ভাগ কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা করছে। তারা জেনেছে পরিবেশের ভারসম্য রক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় বন্য পাখি সুরক্ষা, পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলা ও পাখির বাসার জন্য উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাটির পাত্র স্থাপন করা হচ্ছে। বনবিবি নামের সংগঠনটি ২০১৬ সাল থেকে উপজেলার পৌরসভা, গদাইপুর, রাড়ূলী, হরিঢালী, কপিলমুনি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবস্থিত বিভিন্ন গাছে পাখির বাসার জন্য মাটির পাত্র স্থাপন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। পরিবেশ বান্ধব পাখিকুল রক্ষা, বিরল প্রজাতির বিলুপ্তি রোধ, নির্বিচারে শিকার বন্ধ, প্রজনন ও পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রগুলো নষ্ট না করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে স্ব উদ্যোগে তারা এই কাজটি করে চলেছে।

পরিবেশবাদি সংগঠন বনবিবির সভাপতি প্রকাশ ঘোষ বিধান জানান, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পাখি রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও এদের আবাসস্থল সুরক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন বনবিবি বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে কে সমৃদ্ধ করেছে পাখি। পরিবেশবান্ধব এই প্রাণীটি জীববৈচিত্রের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট নানা কারণে পাখিরা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং আমাদের সুস্থ্য জীবন ধারার জন্যও পাখিদের রক্ষা করা জরুরী। পাখিদের স্বাভাবিক প্রজনন ও তাদের সুস্থ্য জীবনধারাকে টিকিয়ে রাখতে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন। পরিবেশ বান্ধব এই প্রাণীটিকে রক্ষা, বিরল প্রজাতির পাখির বিলুপ্তি রোধ, নির্বিচারে পাখি শিকার বন্ধ, প্রজনন ও পাখিদের অবাদ বিচরণ ক্ষেত্রগুলো নষ্ট না করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

বনবিবির সভাপতি প্রকাশ ঘোষ বিধান বলেন, বনবিবির উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে উপজেলার পৌরসভা, গদাইপুর, রাড়ূলী, হরিঢালী, কপিলমুনি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবস্থিত বিভিন্ন গাছে পাখি বাসার জন্য মাটির পাত্র স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন গাছে প্রায় ১২শ মাটির পাত্র স্থাপন করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন ঝড়সহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে প্রায় তিনশতাধিক মাটির পাত্র ভেঙ্গে গেছে। সে সকল গাছের মাটির পাত্র ভেঙ্গে গেছে সে সব গাছে পুনরায় পাখির বাসার জন্য মাটির পাত্র স্থাপন করা হচ্ছে।

সংগঠনটি পাখির আবাসস্থল নিরাপদ রাখা ও পাখিদের বিচরণস্থল সংরক্ষণ সকলের উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানান তিনি।উপজেলার পৌর সদরসহ আশপাশের ৩/৪টি ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে গাছের ডালে ডালে বাঁধা হয়েছে মাটির ছোট ছোট কলস ও ঝুড়ি। এতে পাখির আনাগোনা বাড়ছে। গদাইপুর গ্রামের চাষী মোবারক ঢালী বলেন,আমি এক সময় পাখি শিকার করতাম।বনবিবির কার্যক্রম দেখে আমি পাখি শিকার বন্ধ করেছি এবং অন্যদেরকে পাখি শিকার করতে নিষেধ করছি।কারন পাখি আমাদের ক্ষেতের পোকা মাকড় খেয়ে অনেক উপকার করে।

দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিকুলতায় পাখির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক। এর ফলে বিষ আক্রান্ত পোকা মাকড় খেয়ে পাখিরা মারা যাচ্ছে। তাছাড়া ফাঁদ, বিষটোপ, ইয়ারগান, গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করা হয়। এমনকি বন্ধুক দিয়েও পাখি শিকার চলে এলাকায়। তবে এখন শিকারীরা প্রকাশ্যে শিকার না করে রাতের বেলায় কৌশলে পাখি শিকার করছে। বনবিবির উদ্যোগে পাখি সুরক্ষায় নানা প্রচার ও গাছে মাটির পাত্র বেঁধে দেওয়ায় শিকারীদের দৌরত্ব অনেক অংশে কমে গেছে। বোয়ালিয়া বীজ উৎপাদন খামারের সিনিয়র সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হারুন জানান, বনবিবির এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

এর ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসম্য রক্ষা হবে। পাখিরা ফিরে পাবে নিরাপদ আবাসস্থল। পাখি দেখে মানুষ মগ্ধ হয়। সকাল আর সন্ধা পাখির কিচির-মিচির হাঁকডাক করে প্রকৃতিকে মুখরিত করে রাখে। পাখি কৃষকের পরম বন্ধু । বোয়ালিয়া ফার্মে পাখি শিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোন শিকারীকে ফার্মে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। আমি নিজেই প্রাণীবিদ ও পাখিপ্রেমী। পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, মানুষের উপকারি বন্ধু। আমি এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। বনবিবির এ কার্যক্রমকে তিনি সাধুবাদ জানান। পরিবেশ সুরক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই পাখি সুরক্ষায় সকলের সহযোগীতা একান্ত কাম্য।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.