নদীর তীরে রাসেলের অভিনব পাঠাগার আলো ছড়াচ্ছে

৩৫০
ফয়সাল চৌধুরী, নেত্রকোনা প্রতিনিধি: ছোট্ট চারটি খুটির উপর ছোট্ট একটি বাক্স। দু’পাশে দুটি বাঁশের বেঞ্চ। উপরে কয়েক পাতা টিনের একটি চালা। ১৫ হাজারেরও বেশি টাকার বই আছে এখানে। অথচ নেই কোনো তালা-চাবি। যে কেউ যেকোনো সময় চাইলেই বাক্সের দরজা খুলে পছন্দের বইটি বেঞ্চে বসে পড়ছেন।
নেত্রকোণা জেলা সদরের মৌগাতি ইউনিয়ন পরিষদ হতে আনুমানিক ১০০০ ফুট উত্তরে এগোতেই এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে। নগুয়া কুশলগাঁও গ্রামের ঢুপিখালী নদী ও ঘন সবুজ বনের উপকূলে অবস্থিত এই পাঠাগারটিকে কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘বইবন্ধু পাঠাগার’ নামে নামকরণ করেছেন।
পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কবি মোঃ রাসেল হাসান (১৬)। ইতোপূর্বেই যে কিনা বিস্ময়কর সব প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। মাত্র ১৪বছর বয়সেই তিনি ‘জ্যোৎস্নাধোয়া রাত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে। অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। বহুমুখী প্রতিভাধর এই অদ্ভুদ বালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প ও ভবিষ্যত লক্ষ্য।
রাসেল একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। পাশেই একটি ঘরে সভা হচ্ছে দেখে তিনি একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলেন ভিতরে কি হচ্ছে। কোনো পাঠাগার প্রতিষ্ঠার আলোচনা সভার কথা জেনে তিনিও সভায় শরিক হওয়ার লোভ সামলাতে পারছিলেন না। কিন্তু বয়স ছিল অন্তরায়। কেবল ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া বালকটি পিতৃতুল্য বয়সী মানুষদের কাছে যেতে সাহস পাননি। এরপর একদিন উক্ত পাঠাগার প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে জানতে পারলেন- এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যারা অবসরে আছেন তারাই কেবল পাঠাগার থেকে বই পড়তে পারবেন।
বিষন্ন এ বালক তখন নিজেই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার চিন্তা করে বসলেন। পরক্ষণেই নিজের সামর্থ্যের দিকে তাকিয়ে দমে যান তিনি, তবে দমে যায়নি তার চিন্তা। সময়ের পরিক্রমায় ভিতরে স্বপ্নকে তিনি লালন করে চলেছেন। অবশেষে দশম শ্রেণীতে এসে সে স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেন। এর পেছনেও আরো কত গল্প লুকিয়ে আছে তার! একদিন তিনি পরিকল্পনা করলেন ছোট্ট একটি বাক্স বানিয়ে একটি খুটিতে রাস্তায় পুতে রাখবেন।
বাক্সটি বইএ ভরপুর থাকবে। মানুষ এখান থেকে নিয়ে নিয়ে বই পড়বে। এটাই হবে আমেরিকান কান্ট্রিগুলোর ন্যায় তার পথপাঠাগার। তখন তার হাতে ছিল ৬ থেকে ৭শ টাকা। বাজারে গিয়ে জানতে পারেন এ টাকায় বাক্স তৈরি হবেনা। এরপর অনেকের কাছে সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হন। ফেসবুকে পোস্ট দিলে কেউ কেউ এগিয়ে আসেন সহযোগিতায়। বানান বাক্স। দেখা দেয় লোহার খুটি তৈরির। আবার হাতে টাকা নাই, করেন ঋণ। বাক্স ও খুটি বানানো হলো।
দেখা গেল উপরে টিন না দিলে হবেনা। অনেক কষ্ট করে সে অর্থ জোগাড় করে পাঁচ পাতা টিন কিনে এনে তার কাকাকে নিয়ে চালাটি তৈরি করেন। কিছু বইও কিনে রাখেন পাঠাগারে। অতঃপর তার অভিনব পাঠাগারে পাঠকের আনাগোনা দেখে ছলছল করে উঠে তার চোখ। খুশিতে বুক ভরে যায়। রাসেল কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে পাঠাগারটির নাম চাইলে মহান কবি কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠাগারটির নাম দেন ‘বইবন্ধু পাঠাগার’।
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ কবি রাসেলের এই পাঠাগারে তাঁর লেখা ৪৩টি বই ও পাঁচটি চেয়ার উপহার দেন এবং আরো বই দিবেন জানান। রাসেলের চোখ এখন উদ্ভাসিত। চারদিক থেকে পাঠক আসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও আসছেন অনেকেই। রাসেল অনেক সময় আড়ালে থেকে দেখেন এ দৃশ্য।
অনেক সময় গিয়ে কথা বলেন। নিজেও সময় পেলেই চলে যান পাঠাগারে। বই পড়েন, সময় কাটান। সপ্তাহে পাঠাগারের পাঠকদের নিয়ে একটি সভাও করেন। পাঠাগার গিয়ে পাঠাগারের পাঠিকা ঝুমা আক্তার বলেন, “বইবন্ধু পাঠাগার আমাদের জ্ঞানের ক্ষুধা মিটাচ্ছে।” বিদ্যুৎ তালুকদার আরিফ বলেন, “আমরা পাঠাগার ছাড়া বিশাল অভাবে ছিলাম। পাঠাগারটি হওয়াতে ভীষণ ভালো লাগছে। সময় পেলেই চলে আসি বই পড়তে।”
সম্প্রতি পাঠাগারের সেরা পাঠকদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভালোবাসার কবি তানভীর জাহান চৌধুরী বলেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, “যে পাঠাগারে কবি নির্মলেন্দু গুণ দৃষ্টি দিয়েছেন সে পাঠাগার দৃষ্টি নন্দিত হবে।” তিনি আরো বলেন, “একদিন বইবন্ধু পাঠাগার হবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো আর রাসেল হবে অধ্যাপক আব্দুলাহ আবু সায়ীদ স্যারের মতো।”
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক প্রফেসর ননী গোপাল সরকার বলেন, “বইবন্ধু পাঠাগার পরিদর্শন করে চমৎকৃত হয়েছি। ঢুপিখালীর তীরে গাছ গাছালির শ্যামল ছায়ায় ভিন্নধর্মী এ পাঠাগার নিরবে নিভৃতে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দিচ্ছে।” ফেসবুকেও পাঠাগার নিয়ে পোস্টে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকদের প্রশংসনীয় কমেন্ট লক্ষনীয়। পাঠাগারে এত বই, আবার তালা নেই।
বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলে কবি মোঃ রাসেল হাসান বলেন, “মানুষ এখন অনেক সভ্য, অনেক বিশুদ্ধ। কিন্তু আমরা তা মনে করিনা। আমাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিই খারাপ। আমাদের চিন্তা পজিটিভ করা উচিত। আমাকে অনেকে বলছিল বই চুরি হয়ে যাবে। আসলে তা না। কে চুরি করবে? যে বই পড়ে সে কখনো চুরি করবেনা। আর যে চুরি করে সে তো পড়বেনা। সুতরাং চুরি হবে কেন। বই পাঠাগার থেকে কেউ চুরি করেনি, করবেও না আশাকরি।
মোঃ রাসেল হাসান আরো বলেন, “সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। ঝড়- বাদলে বই তো ভিজেই যাবে, পাঠাগারটির ক্ষয়ক্ষতিও হবে। এখন প্রশাসন যদি ছোট করে হলেও একটি ঘর নির্মাণ করে দেয় তবে বইবন্ধু পাঠাগার অনেক উপকৃত হবে।”
তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন বইবন্ধু পাঠাগারের অসংখ্য বিল্ডিং হবে। দেশের এ প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের পাঠক পাঠিকারা ছুটে আসবে। পাঠাগারে বিনোদনের জন্য যথাযথ উপকরণ থাকবে। বইবন্ধু পাঠাগারের আলোয় আলোকিত হবে সমাজ ও দেশ।

Comments are closed.