নানামুখী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ

১৫১

॥ ফারাহ মাসুম ॥

অন্তর্বর্তী সরকার যাতে রাষ্ট্র সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু করতে না পারে, তার জন্য ভেতর থেকে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে প্রভাবশালী দেশি-বিদেশি মহল। তারা জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় আগের দলবাজ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের বহাল তবিয়তে রেখেছে। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সময় উগ্র ও আগ্রাসী ভূমিকা নেয়া কর্মকর্তাদের পুলিশ প্রশাসনে রেখে দিয়েছে। এমনকি সামরিক প্রশাসনে আগের সরকারের সময় রাজনৈতিক আনুগত্য পোষণকারী ব্যক্তিরাও যার যার পদে বহাল রয়েছেন। সংখ্যালঘু ইস্যু, গার্মেন্টস খাত, দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি সংবেদনশীল ইস্যুতেও সরকারকে চাপে ফেলে ঘোষিত অঙ্গীকার থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক কাজ করার এখতিয়ার রাখে কিনা, সেই প্রশ্নও করা হচ্ছে।
পরিবর্তন ঠেকানোর এ অপচেষ্টা শুধুমাত্র দেশের ভেতরে চালানো হচ্ছে, তাই নয়- একই সাথে দেশের প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদারদের এ ব্যাপারে প্রভাবিত করার জন্য কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দেশের ভেতরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু উগ্রবাদী তৎপরতায় ইন্ধন দিয়ে সেগুলোকে নিয়ে দেশের বাইরে প্রোপাগান্ডা চালানোয় ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সামাজিক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে এমনভাবে- যাতে একের পর এক ভুয়া খবর ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা সম্ভব হয়। দেখা গেছে, সাম্প্রতিক হিন্দু মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ব্যাপারে যেসব ভিডিও ও ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে, তার অধিকাংশ জালিয়াতি করে তৈরি বলে ফ্যাক্ট চেকিংয়ে প্রমাণ হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশের উত্তর-দক্ষিণ সীমান্তে এমন কিছু তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে- যাতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। এসব ঠেকাতে সামরিক প্রশাসনকে বিন্যাস করার উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী প্রশাসনে ধীরগতি : যেকোনো সরকারের পরিবর্তন উদ্যোগের জন্য জনপ্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৫ আগস্টের আগে দেড় দশকের শাসনকালে ফ্যাসিবাদী সরকার শীর্ষ ও মাঠ প্রশাসনে তিন স্তরে তাদের অনুগত কর্মকর্তাদের পদায়ন করেছে। এ সময় বিভিন্ন ব্যাচে বহুসংখ্যক যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত রেখে নিচের স্তরে রেখে দেয়। অনেক যোগ্য কর্মকর্তা নিচের পদে অবসরে চলে যান। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন না এনে আগের প্রশাসন বহাল রেখে সরকারকে কার্যকর করার যুক্তি দেয়া হয়। এতে করে আগের কর্মকর্তারা পুরো প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। কিন্তু এ বিষয়ে অন্তর্বর্র্তী সরকার ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ যাতে নিতে না পারে, তার জন্য প্রধান উপদেষ্টার জনপ্রশাসন বিষয় দেখাশোনার জন্য এমন একজন কর্মকর্তাকে বসানো হয়, যিনি পরিবর্তনের বিপ্লবী চেতনাকে ধারণ না করে আগের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য তৎপর বলে মনে হয়। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের চাপে তাদের অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি দেয়া হলেও এসব কর্মকর্তাকে কার্যকর পদে পদায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে করা হয়নি। তাদের একই ব্যাচের কর্মকর্তারা সিনিয়র সচিব পদে বহাল থাকলেও চাকরিরত বঞ্চিত কর্মকর্তারা কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পায়নি। এদিকে ১৯৮২ ব্যাচের ৭ জন পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক সচিব পদে নিয়োগদান করা হলেও পরবর্তী ব্যাচের পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া বাকিদের নিয়োগ দেয়া হয়নি। মাঠপর্যায়ে ১ মাস ধরে দুই বিভাগীয় কমিশনার শূন্য। সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা নেই কমপক্ষে ৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) নেই ৮ জেলায়। যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য নোটিশ করা হলেও এসএসবির সভা গত ৪ মাস ধরে স্থগিত। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ প্রায় বন্ধ। মাঠ প্রশাসনে নিয়োগদানের জন্য নতুন ফিট লিস্ট তৈরিরও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে অনেকখানি অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র।
বিগত সরকারের সময় ‘অকারণে বঞ্চিত’দের পদোন্নতি দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তাদের পদায়ন হচ্ছে না। অন্যদিকে বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়িত অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব এবং উপসচিবরা আছেন বহাল তবিয়তে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের মত হচ্ছে, সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। এসব পদ শূন্য বা ফাঁকা রাখা কোনোক্রমেই ঠিক হচ্ছে না। এতে জনসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। যোগ্য কর্মকর্তার অভাববোধ করলে সরকার ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য সাবেক যোগ্য কর্মকর্তাদের উচ্চপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারে। বিরাজমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এছাড়া পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক যোগ্য লোক আছেন, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তবে পদায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই সততা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের বক্তব্য হলো, কিছু কর্মকর্তা এবং একজন উপদেষ্টার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জনপ্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বর্তমান তারা বিপ্লবী সরকার তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমরা সরকারকে বলেছি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব আকমল হোসেন আজাদ ও একজন উপদেষ্টাকে অপসারণ করতে হবে। তারা নানা ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে তাদের দুর্নীতি তদন্তে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও (বিএএসএ) প্রশাসনে বিরাজমান স্থবিরতার অবসান চেয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়ে আমরা বার বার বর্তমান প্রশাসনকে অনুরোধ করার পরও অজানা কারণে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না বলে অ্যাসোসিয়েশন উল্লেখ করেছে।
বিগত সরকারের সময় বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ২০৬ কর্মকর্তাকে আগস্টে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে তাদের আগের মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে থেকে মাত্র কয়েকজনকে সচিব হিসেবে পদায়ন করা হলেও বিগত সময়ে পদোন্নতি বঞ্চিত অধিকাংশ কর্মকর্তাকে কাক্সিক্ষত স্থানে পদায়ন করা হয়নি। যুগ্ম সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তাদের পদায়নের আগে প্রধান উপদেষ্টার পূর্বানুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের পদায়নসংক্রান্ত ফাইল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো হলেও এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে ঢাকা ও রংপুর বিভাগে কোনো বিভাগীয় কমিশনার নেই। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনাররা রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও দিনাজপুর কোনো ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ডিসি নিয়োগ দিতে গিয়ে ঘটে গেছে কেলেঙ্কারির ঘটনা। মাঝারি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে, তারা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। গঠন করা হয়েছে উপদেষ্টাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠ প্রশাসনে ডিসি পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিসি জেলা পর্যায়ে ১২০টি কমিটির সভাপতি। আইনশৃঙ্খলা থেকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সবকিছুতেই ডিসিকে তদারকি করতে হয়। সরকারের রাজস্ব আহরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কালেক্টরেট হিসাবে ডিসি। এছাড়া স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের তদারকিও করেন ডিসি। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে সস্পৃক্ত থাকলেও ১ মাসের বেশি সময় ধরে আট জেলায় ডিসি নেই।
‘মাইনাস টু’র আশঙ্কা
ওয়ান-ইলেভেনের অভিজ্ঞতার কারণে মাইনাস টু নিয়ে প্রায় আলোচনা হয়। এ আশঙ্কা থেকেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বা এ ধরনের কোনো চিন্তাভাবনা নেই বলে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস শাখা থেকে বলা হয়েছে, আমাদের সরকার মাইনাস টু কী জিনিস, এটা জানে না এবং মাইনাস টু নিয়ে সরকারের কোনো পর্যায়ে কোনো ধরনের আলোচনা কখনো হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
দেশের রাজনীতিতে মাইনাস টু ফর্মুলাটি ২০০৭ সালের এক-এগারোর সরকার সামনে এনেছিল। সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে দল দুটির কিছু নেতা সক্রিয় হয়েছিল। ওই নেতারা সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত দেশের রাজনীতিতে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বিষয়টি আবারো আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তার দল বিরাজনীতিকরণে বিশ্বাস করে না এবং আবার  ‘মাইনাস টু’  দেখতে চান না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বিপ্লবের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির একটি গ্যাপ তৈরি করার জন্য এ ইস্যুটিকে চাঙ্গা করা হয়ে থাকতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন
এদিকে বিভিন্ন বিদেশি মিডিয়ায়ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিহিত করে আমেরিকান সাময়িকী দি ডিপ্লোম্যাটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকার মন্ত্রিসভা, আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা পৃথকীকরণের প্রকৃতি পরিবর্তন করতে চাইছে এবং রাষ্ট্র গঠনে বিনির্মাণের কাজটি করে যাচ্ছে। একটি অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো একটি প্রেক্ষাপটে, এই জাতীয় রাষ্ট্র-নির্মাণের প্রচেষ্টা একটি প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতার কারণ হতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে, পর্যাপ্ত স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ ছাড়াই এবং নির্বিচারে রাষ্ট্রযন্ত্রের পুনর্বিন্যাস করার প্রচেষ্টা প্রায়ই পর্যাপ্ত ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কি ভিন্ন হবে? শুধু সময়ই বলে দেবে।
এ প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হয়। বলা হয়েছে, এটির সংবিধান ও সরকারের সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনের বৈধতা আছে কি না, সাংবিধানিক কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই পদত্যাগ করতে বাধ্য করে এবং আন্তর্জাতিক পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এমন একটি এজেন্ডা নিয়ে চলতে থাকে, তবে এটি মূলত একটি গণপরিষদের কার্য সম্পাদনের পাশাপাশি সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করে, যা সাধারণত একটি নির্বাচিত সরকারের ভূমিকা হবে। এ কথা বলার অর্থ হলো এ সরকার যাতে সংস্কারের উদ্যোগ বাদ দিয়ে আগে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থাতেই একটি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেয়।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রকৃতি পরিবর্তন করতে চাইছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন এবং পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন গঠন। এটি প্রশাসনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনাকারী কর্মীদের মধ্যে বড় আকারের পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রযন্ত্রের চরিত্র পরিবর্তনের একটি চলমান প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে। এটি না হলে রাষ্ট্র আগে যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলতে দেয়া হবে।
অনেক রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, যখনই নতুন রাজনৈতিক দল এবং নেতারা ক্ষমতায় আসে, তখনই ঊর্ধ্বতন স্তরে কিছু মতাদর্শগতভাবে সমন্বিত আমলাদের নিয়োগ করার চেষ্টা করা হয়। যা-ই হোক, বাংলাদেশে সব স্তরে প্রশাসন পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা অনুকূল রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্গত তা নিশ্চিত করার জন্য বিপুলসংখ্যক নিয়োগ করা হচ্ছে। বাস্তবে খুব সামান্যই প্রশাসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ডিপ্লোমেটের প্রতিবেদনে মূলত ভারতের উদ্বেগকে তুলে ধরে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে, অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ববর্তী সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থায়নে ব্যবহৃত ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ঢাকাকে ৬৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ প্রদানের দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। এমনও খবর রয়েছে যে, ভারতীয় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো বাংলাদেশের কাছ থেকে বকেয়া ছাড় চেয়েছে, যার মধ্যে আদানি গ্রুপও রয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যাদের বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের কাছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে।
অত্যন্ত সুকৌশলে ভারতীয় লবি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে আগের সরকারের নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য চাপ তৈরি করতে চায়। ডিপ্লোমেটের প্রতিবেদনে সেই লবির একটি প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। তাতে বলা হয়, ঢাকা পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক সম্মত চুক্তিতে পুনরায় আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করা অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করবে এবং বর্তমান ও সম্ভাব্য স্টেকহোল্ডারদের উদ্বিগ্ন করবে। দেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিরতা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে। বৃহত্তর প্রশ্নটি রয়ে গেছে যে, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশি নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে কি না। এসব কথা তোলার অর্থ হলো সরকার আগে যেভাবে ছিল, সেভাবে রেখে দেয়া- দিল্লি লবি এটি চাইছে।
ভারত বাংলাদেশের সাথে তার সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রতিবেশী অঞ্চলে দ্রুত পরিবর্তন সামাল দিতে তার অতীত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করতে চাইবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এখন বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে যে চাপ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তৈরি করা হচ্ছে, প্রতিবেদনটি তার অংশ হতে পারে।
প্রতিবিপ্লবের আলামত?
একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে প্রতিবিপ্লবের আলামত নিয়ে একটি শীর্ষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, বিপ্লবের ছায়াসঙ্গী হচ্ছে প্রতিবিপ্লব। যেখানেই বিপ্লব সেখানেই প্রতিবিপ্লবের আলামত। কোথাও সফল হয়। কোথাও ব্যর্থ। বাংলাদেশের বিপ্লব নিয়েও দেশে-বিদেশে আলোচনা এখন তুঙ্গে। নানামুখী প্রচারণা। নানা ছক তো আছেই। সরকারের ভেতরেও একটি মহল প্রতিবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে। যদিও এর আগে অনেকগুলো পরিকল্পনা বা ছক ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু পরাজিতরা বসে নেই। তারা বিজয়ের হাসি হাসতে চায়। তাই বলছে, ক’দিন যায় দেখুন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এখন টানটান উত্তেজনা। বলা হচ্ছে, প্রতিবিপ্লব এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
প্রতিবেদক লেখেন, এ বিষয়টি নিয়ে তিনি  প্রশ্ন রেখেছিলেন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। তিনি বললেন, ‘এটা নতুন কোনো খবর নয়। আমরা সবাই জানি এবং দেখছি। নানাভাবে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। চোখ-কান খোলা রেখেছি। যা ব্যবস্থা নেয়ার নিচ্ছি।’
প্রতিবেদক লিখেছেন, তাকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা আমাদের কাজ করছি। কিছু ভুল-ত্রুটি তো আছেই। এটা দূর করে আমরা গন্তব্যে যেতে চাই। আমরা তো বলেছি, সংস্কার ও নির্বাচন- আমরা দুটিই চাই। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে আমরা থাকতে চাই না। আমার তো সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি তো জানো, আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখাই। এখন তো আমি আর কোনো স্বপ্নও দেখতে পারি না। যেখানে ছিলাম আমি একজন মুক্ত মানুষ।’
এখানে কি আপনি মুক্ত নন? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিবেদককে ড. উইনূস বলেছেন, “মুক্ত কিনা জানি না, তবে ফাইলে বন্দি। এন্তার ফাইল আমাকে সই করতে হয় প্রতিদিন। অন্যকাজে সময় দিতে পারছি কম- এটা সত্য। বাস্তব সত্য। সব ফাইল কি পড়তে হয়? সব ফাইল পড়তে হয় না। কিন্তু সই করতে হয়। দুনিয়ায় ফাইল উঠে যাচ্ছে, সবই ডিজিটাল। আমরা এখনো ‘লাল ফিতায় বন্দি’। এ অবস্থার অবসান কবে হবে।”
উপদেষ্টামণ্ডলী প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘ভালো-মন্দ সবই আছে। কেউ দুর্বল, কেউ সবল। আমি তাদের কাজ দেখছি, মানুষও দেখছে। একটা জায়গায় পৌঁছে তো আমাকে নম্বর দিতে হবে। সেটার কাজ এখন চলছে। মানুষ চেয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা কী পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিলাম, এটা তো অজানা নয়। চারদিকে তো অস্থিরতা। মানুষ তো স্বস্তি চায়। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। মানুষ পরিবর্তন দেখতে চায়।’
জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনটিতে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মাঠে-ময়দানের খবরেও অনেক উদ্বেগ আসছে। ৫ আগস্টের আগের মামলায় বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের হয়রানি গ্রেফতার করার খবর আসছে। থানা আক্রমণ ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ এনে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হচ্ছে। এর মধ্যেও ভালো খবর হলো জুলাই আগস্টের গণহত্যার জন্য দায়ী ফ্যাসিবাদের কর্তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য ট্রাইব্যুনাল তার কাজ শুরু করছে।

 

সূত্র: সাপ্তাহিক সোনার বাংলা