মেয়াদ শেষে পুলিশ প্রটোকলে ক্যাম্পাস ছাড়লেন রাবি ভিসি

* নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অ্যাডহকে বিশাল নিয়োগ * বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগর ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ

0 ৬০০

রাবি প্রতিনিধি : নানা দুর্নীতির খড়গ ভারি করার পর অবশেষে বিদায় নিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ভিসি অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। বৃহস্পতিবার দুপুরে তার মেয়াদ শেষ হলে পুলিশ প্রটোকলে ক্যাম্পাস ছাড়েন তিনি। এর আগে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে রাবি ও মহানগর ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ক্যাম্পাস ছাড়ার মুহুর্তে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছি বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা খাত, সংস্কৃতি চর্চায় যথেষ্ট অবদান রেখেছি। সেটা আপনারা মূল্যায়ন করবেন। কতজন নিয়োগ দিলেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে পরে জানতে পারবেন বলেন তিনি।

এ দিকে বিদায়ের আগ মুহূর্তে ভিসি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে অ্যাডহক ভিত্তিকে ১৪১ চাকরিপ্রত্যাশীকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।এর মধ্যে ৮৫ জন উচ্চমান সহকারী, ৯ জন শিক্ষক ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীসহ ৪৭ জনের নাম রয়েছে।

 

ভিসি স্বাক্ষরিত ওই নোটিসে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭২ এর ১২ (৫) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক) ছয় মাসের নিয়োগ দেওয়া হলো। অবিলম্বে এই নিয়োগ কার্যকর করা হোক।

এ সময় চাকরিতে যোগদানের জন্য ভিসি ভবনে চাকরিপ্রার্থীরা ভিড় করছেন বলে জানা গেছে।

 

তবে ইস্যুকৃত নিয়োগপত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম স্বাক্ষর করেননি। তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে।

 

নিয়োগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা থাকা অবৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত কোন বিষয়ের সাথে আমার সম্পর্ক নেই। নিয়োগ হয়েছে কি না সেটাও আমার জানা নেই। কোন অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে থাকব না বলেই অজ্ঞাতবাসে আছি।’

 

এর আগে দুপুরে নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন পদে নিয়োগের খবর পেয়ে সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও চাকরিপ্রত্যাশীরা অবস্থান নেয়। এরই মধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার মামুনুর রশীদ ১২২ জন চাকরি প্রত্যাশীর নিয়োগ নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে ভিসির বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসার খবর পেয়ে মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে ধরে মারধর করেন।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে সেখানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দফায় দফায় চলতে থাকে সংঘর্ষ। পরে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ করে। ফলে হামলাকারী মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায়।

 

এ ঘটনায় শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান চঞ্চল, হবিবুর হলের সেকশন অফিসার আবদুল্লাহ আল মাসুদসহ আরও অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। আহত সবার নাম ও পরিচয় জানা যায় নি।

রাবির শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান চঞ্চল জানান, আজ রাবি ভিসি আব্দুস সোবহানের মেয়াদের শেষ দিন। তিনি চাকরি প্রত্যাশী ১২২ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে প্রচার হলে মহানগর ছাত্রলীগের চাকরিপ্রত্যাশীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। এ সময় তারাও চাকরি দাবি করে। এ নিয়ে সেকশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তারা হামলা চালায়। এ সময় আমি এগিয়ে গেলে তারা আমাকেও লাঞ্ছিত করে।

 

জানতে চাইলে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতানুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি উপাচার্য অবৈধভাবে ১২২ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। এতে মতনৈক্য হওয়ায় উভয় পক্ষের সংঘর্ষ হয়।

 

এ দিকে ২০১৭ সালের ৫ মে দ্বিতীয়বারের মতো চার বছরের জন্য ভিসি পদে নিয়োগ পান। ভিসি পদে দায়িত্বের পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। নিয়োগ বাণিজ্য, নিজ মেয়ে-জামাতাকে
নিয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা দুর্নীতিতে জড়ান ভিসি এম আব্দুস সোবহান। শেষ সময়েও যেন নিয়োগ সম্পন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি।

 

সেই অভিযোগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের একাংশ আন্দোলন শুরু করে। যা ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত গড়ায়। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি প্রশাসনের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তসহ ৩০০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুদক ও ইউজিসিসহ চার দপ্তরে জমা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকদের একাংশ।

পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত শেষে ৭৩৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় ইউজিসি গঠিত তদন্ত কমিটি। গত বছরের ২০ অক্টোবর দেওয়া ওই প্রতিবেদনে ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ২৫টি অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে বলেউল্লেখ করা হয়।

এর মধ্যে ভিসি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে (রাষ্ট্রপতি) অসত্য তথ্য দেওয়া, শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেন, নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে নিজের মেয়ে এবং জামাতাকে
নিয়োগ, বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে ৩৪ জন অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ মেলে ইউজিসি গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে।

এ ছাড়া ভিসি ডুপেক্স বাড়ি ১৮ মাস ধরে দখলে রাখার অভিযোগে পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে দিতে নির্দেশ দেয় ইউজিসি। পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রণালয় কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরণের নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দেয়।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.