রাবি গবেষকের সাফল্য : তুঁতে মিলল ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধী গুণ

0 ১৭৮
আসাদুল্লাহ গালিব, রাবি প্রতিনিধি : এক গবেষণায় উঠে এসেছে, তুঁত গাছের পাতা, ফল, বাকল এমনকি মূল সবই ঔষধি গুণসম্পন্ন। এটি কাজ করে ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ প্রতিরোধক হিসেবেও। এ সুযোগ কাজে লাগানো গেলে খাদ্য ও ওষুধ শিল্পে বিপুল সম্ভাবনাময় বহুমুখী এ উদ্ভিদে পরিবর্তন আনতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি।
২০১০ সাল থেকে একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে তুঁতের ক্যানসার প্রতিরোধী ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করে আসছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম খুরশীদ আলম। গবেষণায় তারা নিশ্চিত হন তুঁত ক্যানসার প্রতিরোধী। বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত গবেষণা এগিয়ে নেন। একসময় বরেন্দ্রখ্যাত উত্তরাঞ্চলে রেশমের রাজত্ব ছিল। পলু বা রেশমকীট পালনে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। পতিত জমি, বাড়ির আশপাশ, বাধের ধার, জমির আইল, রাস্তার দুই পাশ—সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে তুঁত গাছ চাষ। লাভজনক হওয়ায় এটি আবাদও করতেন কেউ কেউ। কিন্তু সময়ের ফেরে দুর্দিন নেমে আসে রেশম শিল্পে। যত্নের তুঁত গাছও একসময় হয়ে যায় অবহেলার।
গবেষক ড. এএইচ এম খুরশীদ আলম বলছেন, রেশম পোকার পুরো জীবনচক্র আবর্তিত হয় তুঁত পাতায়। এর কারণ খুঁজতে গিয়েই তারা পাতাটির অবাক করা পুষ্টিগুণ পান। একটা পর্যায়ে তারা তুঁত ফল, বাকল ও মূল নিয়েও আলাদাভাবে গবেষণা করেন। সব অংশেই কম-বেশি প্রায় একই পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি এ গবেষণাপত্র প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োমেড সেন্ট্রাল রিসার্চ নোট। পরে আরেকটি গবেষণা নিয়ে ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘পোলস ওয়ান’- এ গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সালে ড. এএইচএম খুরশীদ আলম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন স্বর্ণপদক পান।
ড. খুরশীদ আলম জানান, তুঁত ফলের ৮৫ শতাংশই পানি। এছাড়া শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২ শতাংশ ফাইবার, ১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রোটিন ও দশমিক ৫ শতাংশ চর্বি বিদ্যমান। প্রতি কাপ অর্থাৎ ১৫০ গ্রাম তুঁত ফলে শক্তি থাকে মাত্র ৬০ কিলোক্যালরি। ভিটামিন-সি থাকে ৩০ দশমিক ২ মিলিগ্রাম। এছাড়া ভিটামিন এ ও বি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়ামও রয়েছে। কিশমিশের মতো শুকিয়ে তুঁত সংরক্ষণ করা যায়। এতে প্রোটিনের মাত্রা বাড়ে। শুকনো তুঁত ফলে শতাংশ ২० কার্বোহাইড্রেট, ১৪ শতাংশ ফাইবার, ১২ শতাংশ প্রোটিন ও ৩ শতাংশ চর্বি রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সতেজ একটি ভুঁত পাতায় ৪ দশমিক ৭২ থেকে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ অপরিশোধিত প্রোটিন, ৮ দশমিক ১৫ থেকে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ ফাইবার, ৪ দশমিক ২৬ থেকে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ অ্যাশ, দশমিক ৬৪ থেকে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ অপরিশোধিত চর্বি ও ৮ দশমিক শূন্য ১ থেকে ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকে। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম তাজা তুঁত পাতায় ১৬০ থেকে ২৮০ মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড ও বিটা ক্যারোটিন, ৪ দশমিক ৭০ থেকে ১০ দশমিক ৩৬ মিলিগ্রাম খনিজ লৌহ, দশমিক ২২ থেকে ১ দশমিক ১২মিলিগ্রাম দস্তা, ৩৮০ থেকে ৭৮৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ১১৩ থেকে ২২৪ কিলোক্যালরী শক্তি বিদ্যমান। পাতা এবং ফলের মত তুঁত গাছের বাকল এমনকি মূলেও যথেষ্ট পুষ্টি উপদান পাওয়া যায়।
ড. এএইচএম খুরশীদ আলম বলেন, মুলত তুঁত পাতা অ্যান্টি -থাইরোসিনেস, অ্যান্টি – ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি – ইনফ্ল্যামেটরি। তুঁত ফল এন্টি-ক্যানসার, অ্যান্টি -ডায়াবেটিক, অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট এবং, অ্যান্টি- নিউরোডিজেনারেটিভ। তুঁত গাছের বাকল, অ্যান্টি -মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি -ইনফ্ল্যামেটরি। এছাড়া এর মূল অ্যান্টি –হাইপারলেপিডেমিয়া এবং, কার্ডিওভাসকুলার ট্রাবল রিলিভার।
তিনি যোগ করেন, বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ব্যাধি ক্যান্সার।কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসায় সফল ও নিরাপদ ওষুধ খুবই কম। তুঁত পাতা, ফল এবং মূল ক্যান্সার প্রতিরোধী। এর এন্টিঅক্সিডেন্ট দেহের ফ্রি র‌্যাডিক্যালগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কাজ করে। এর ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ হয়।
এই গবেষক বলছেন, এখনকার সময়ে অন্যতম সমস্যা স্থুলতা। এটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানান রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারের আগে তুঁত পাতার নির্যাস খেলে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে আসে। এতে শরীরের অস্বাভাবিক চর্বি কমে যায়। তুঁত ফলের রস কিংবা পাতার নির্যাসে জৈব্য যৌগ ১-ডি অক্সিনোজিরিমাইসিন বিদ্যমান। এটি রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনে। একই সাথে অগ্ন্যাশয় এবং কিডনির জটিলতা ঠেকায়।
তিনি বলেন, তুঁতে জেক্সানথিন বিদ্যমান। এটি চোখের রেটিনাকে ক্ষতি থেকে বাঁচায়। আবার চোখে ছানিপড়াও আটকে দেয়। তুঁত ফলে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তুঁতে ডায়েটরি ফাইবার বিদ্যমান। এটি হজম তরান্বিত করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তুঁতে উপস্থিত অ্যালকালয়েডগুলি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তুঁত গাছে গুরুত্বপূর্ণ ফ্ল্যাভনয়েড রেসভেরট্রোল পাওয়া যায়। যা স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।
এছাড়া তুত ফল এবং পাতার নির্যাস স্ট্রেস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এর ছালে অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল রোগের চিকিৎসায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ব্রণের বৃদ্ধি রোধ করে। কগনিটিভ ডিসঅর্ডার এবং বিভিন্ন ধরনের নিউরোনাল ডিসফাংশনের চিকিৎসায় যেসব ঔষধি গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তুঁত তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।
তুঁত স্নায়ু-অবক্ষয় বিলম্ব করতে পারে। এটি লিভার সুস্থ রাখে। তুঁত ত্বক ও চুলকে স্বাস্থ্যকর এবং চকচকে চেহারা প্রদান করে। তুঁতকে অন্যান্য ঠান্ডা, ফ্লু-এর মতো সমস্যাগুলির চিকিত্সার জন্যও ব্যবহার হয়।
জানা যায়, তুঁত (Mulberry) এর আদিনিবাস চীনে। ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তুঁত চাষ হয়। বিশ্বজুড়ে তুঁতের ১২টি প্রজাতি রয়েছে। তবে আমাদের দেশে Morus nigra, Morus rubra Morus alba এই তিন প্রজাতির তুঁত গাছ পাওয়া যায়।
মূলত: উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ তুঁত চাষের জন্য প্রসিদ্ধ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.