মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
উৎসবমুখর শরৎকালের অবসানে গুটি গুটি পায়ে শীতের পূর্বে আগমন ঘটে হেমন্তের। হেমন্তের হিমেল বাতাস, সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রকৃতিতে বেজে ওঠে শীতের আগমনী বার্তা। হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু, বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস মিলে হেমন্তকাল।
মাঠের পর মাঠ যতদূর চোখ যায় পাকা সোনালি ধানের ঢেউ। কৃষকের ঘরে ধান তোলার দৃশ্য, কৃষক-কৃষাণির আনন্দ, লাউয়ের মাচায় লিকলিকে প্রতিটি ডগার খিলখিল হাসি, হাওর-বিলে অতিথি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ, খেজুরের রস সংগ্রহ করতে গাছিদের প্রস্তুতি, নতুন আলু তোলার ব্যস্ততা, সবই হেমন্তের রূপের বাহার। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন যেমন বলেন-
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
হেমন্ত ঋতুতে চলে শীত-গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুর দিকে এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে অন্য অনুভূতি। ভোরের আকাশে হালকা কুয়াশা, শিশিরে ভেজা মাঠ-ঘাট তারপর ক্রমেই ধরণী উত্তপ্ত হতে থাকে। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় বাংলার প্রকৃতি ও জীবন।
প্রকৃতির মতো হেমন্ত মানুষের জীবনেও পরিবর্তন নিয়ে আসে। এ ঋতুতেই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল ধান ঘরে ওঠে। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুম’। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের ১ম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। সারা বছরের মুখের অন্নের জোগানও আসে এ সময়। হেমন্ত তাই সুখ-সমৃদ্ধির কাল।
হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। গ্রাম-বাংলায় শুরু হয় নবান্নের উৎসব। গ্রামের পরিবেশে আনন্দ বিরাজ করে। নবান্ন হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাম্য মেলা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানোর আয়োজন, ঢেঁকির শব্দ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রকৃতিকে বরণ করে নেয় হেমন্তে। তাই এ সময় মানুষের মুখের হাসিটা অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই দেখা যায়। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়।
‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা...’। কবি কল্পনার এ বসুন্ধরা আসলে হেমন্তের এই বাংলা। কারণ হেমন্ত ধনধান্য আর পুষ্পে ভরে দেয় বাংলার মাঠ-ঘাট প্রান্তরকে। শরতে গজিয়ে ওঠা উদ্ভিদ হেমন্তে ডানা মেলে, রূপ ছড়ায়। শুধু মাঠভরা ফসল নয়, বাড়ির উঠোন-আঙিনা ও আশপাশ ভরে ওঠে নানা রঙের ফুল আর শাক-সব্জিতে। এটাই পল্লী-প্রকৃতির সৌন্দর্য।
হেমন্ত মানেই নব উচ্ছ্বাস, নব সুর, নব শিহরণ। হেমন্তের নবজাগরণে কাননে কাননে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লি¬কা, শিউলি, কামিনী, পদ্ম, হাসনাহেনা, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজ-অশোকসহ নানা রঙ ও ঘ্রাণের অসংখ্য জাতের ফুল। সেসব ফুলের পাপড়ি ও গাছের পাতায় পাতায় ভোরের মৃদু শিশিরের স্পর্শ জানিয়ে দেয় শীত আসছে।
হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। হেমন্তে যে ফলগুলো সচরাচর পাওয়া যায় সেগুলো হলো- জাম্বুরা, জলপাই, কদবেল, আমড়া, চালতা, আমলকি ও কামরাঙা, নারিকেল এ ঋতুর প্রধান ফল। গৃহিণীরা সারা রাত জেগে নারিকেল দিয়ে রকমারি মুখরোচক পিঠা ও নানান সুস্বাদু খাবার তৈরি করে এ ঋতুতে।
হেমন্ত এলে অনেকেই মাছ ধরতে নেমে পড়ে পানি কমে যাওয়া খাল-বিল-নদী-ডোবায়। নানারকম দেশীয় মাছে গ্রামগঞ্জের বাজার সয়লাব হয়ে যায়। টেংরা, পুঁটি, বোয়াল, চিতল, আইড়, শিং, মাগুর, কইসহ কত রকমের মাছ যে ধরা পড়ে এ সময়।
হেমন্তে হাওড়-বাওড়-বিলে তাই ধান কাটার পাশাপাশি মাছ ধরার চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। মাছ ধরা শেষে কোমরে বাঁধা খালই ভর্তি মাছ নিয়ে বীরবেশে ঘরে ফেরার সেকি আনন্দ। সেইসঙ্গে কিষানির রান্নাঘর থেকে তাজা মাছ ভাজার মনলোভা সুগন্ধ জিভে পানি এনে দেয়।
হেমন্তের প্রকৃতি অপূর্ব মায়াময়। এ প্রকৃতি শুধু মানব হৃদয়ে আনন্দের বান ডেকে আনে তাই না। এ প্রকৃতি জীববৈচিত্র্যের আধার। এ সময় পাখিরা নির্ভয়ে বাসা বাঁধে গাছের ডালে। প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে উড়ে চলে ইচ্ছেমতো। নানা রঙের ফড়িং উড়ে চলে। বসে ডালে ডালে। আনন্দ দেয় শিশু-কিশোর মনে। দোয়েল-শালিকের অবাধ বিচরণ দেখা যায় ডালে ডালে, ফসলের মাঠে, কৃষকের আঙিনায়।
এ সময় আবহমান বাংলায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়। এ কারণেই হয়তো ধান কাটতে কাটতেই খান আতাউর রহমানের কালজয়ী গান গেয়ে ওঠেন কোন তরুণ কিষাণ-
হায়রে আমার মন মাতানো দেশ
হায়রে আমার সোনাফলা মাটি
রূপ দেখে তোর যেন আমার হৃদয় ভরে না
তোরে এতো দেখি তবু আমার পরান ভরে না।
সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম