বগুড়ায় হাইব্রিড মরিচের প্রায় ৩’শ নার্সারীতে ২৪ কোটি চারা উৎপাদন, যাচ্ছে ৩০ জেলায়

২০০

দীপক সরকার, বগুড়া: বগুড়ার লাল মরিচও দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে। আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ নানা জাতের সবজি উৎপাদনে বগুড়ার কৃষকরা সোচ্চার। এবার সেই কৃষকরা ৫০ কোটি টাকার আগাম জাতের সবজির চারা উৎপাদনে মহাকর্মযজ্ঞ চলছে । সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন নার্সারি মালিক ও শ্রমিকরা। চলতি মৌসুমে ৩ শতাধিক নার্সারিতে হাইব্রিড মরিচের মধ্যে কারিশমা, টাইগার, কিসমত, সুলতান, লাইলা, ১৭৫৩, লাইট মাস্টার, ময়নামতি, গ্রীন সুপার মরিচের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। রোগবালাই কম এবং ফলন বেশি হওয়ায় চাষিদের কাছে এসব জাতের চাহিদাও বেশি। তবে ৩ দফায় ২৪ কোটি হাইব্রিড মরিচের চারা উৎপাদন ও বিপণনের প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, সবজির চারা উৎপাদনকারী গ্রাম বলে খ্যাত বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার শাহনগর ও বড়পাথার গ্রাম। সবজি নার্সারি পল্লীতে কৃষকদের পদচারণে এখন মুখর। কেউ জমি তৈরি করছেন, কেউ বীজ বপন করছেন, কেউ বীজ বপনের পর পরিচর্যা করছেন। আবার কেউ চারা বিক্রি করছেন। সারাবছর এখানে চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সবজি চারা পল্লীতে চারা ভালো হওয়ায় নতুন নতুন জেলা থেকে কৃষকরা আসছেন চারা নিতে। এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বড় সবজি নার্সারি পল্লী। এখানে রীতিমতো সবজির চারা উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে।
১৯৮৫ সালের দিকে প্রথমে শাহনগর বড়পাথার এলাকায় সবজি নার্সারি ব্যবসা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এর প্রসার ঘটে বর্তমানে শাহনগর, বড়পাথার, চুপিনগর, দুরুলিয়া, বৃ-কুষ্টিয়া, খোট্টাপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০০টি ছোট-বড় নার্সারি। এখানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, বেগুন, পেঁপেসহ হাইব্রিড জাতের ৮ থেকে ৯ রকমের মরিচের চারা উৎপাদন করা হয়। তবে সবজির চারা গ্রামের মূল চারা হিসেবে বিক্রি হয় মরিচ চারা। হাইব্রিডসহ একাধিক জাতের মরিচের চারা বিক্রয় হয় এখানে। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে বিভিন্ন বয়সি নারী পুরুষসহ হাজারো মানুষের। শাহনগরের নার্সারি পল্লী থেকে দেশের প্রায় ৪৫ থেকে ৫০টি জেলা থেকে চারা নিতে ভিড় করছেন কৃষকরা।
শাহনগর গ্রামের নাহিদ নার্সারির মালিক আপেল মাহমুদ জানান, কাক ডাকা ভোর থেকেই নার্সারি পল্লীতে শুরু হয় ভ্যান, রিকশা, টেম্পুর আনাগোনা। দূর-দুরান্ত থেকে চারা নিতে আসা চাষীদের পদরাচনায় মুখরিত ওঠে নার্সারিপল্লী। বাইরের জেলা থেকে চারা কিনতে আসা চাষীরা আগের দিন এসে রাত্রী যাপন করেন। পরদিন সকালে চারা নিয়ে বাড়ি ফিরেন।
শাজাহানপুরে উৎপাদিত এসব মরিচ ও সবজি চারা ছড়িয়ে পড়ছে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, নাটোর, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, মঠবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ অন্তত: ৩০ জেলায়। মরিচ ও সবজি উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে দেশজুড়ে।
আবার কুরিয়ার-পার্সেলের মাধ্যমে অনেকে নিজ জেলাতে বসেই কিনছেন শাজাহানপুরের উন্নত মানের হাইব্রিড মরিচ ও সবজি চারা। তিনি আরও জানান, শাহনগরের অভিজ্ঞ নার্সারি মালিক-শ্রমিকরা মরিচের চারার পাশাপাশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুনসহ সব ধরণের সবজির চারাও উৎপাদন করছেন। দরিকুল্ল্যা গ্রামের সততা নার্সারির মালিক মোমিনুল ইসলাম জানান, বেড প্রস্তুত করে চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি প্রথম দফায় নার্সারিগুলোতে মরিচের বীজ বপন করা হয়েছিল।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে চারা উত্তোলন শুরু হয়। কিন্তু প্রচন্ড তাপদাহ এবং পরে অতিবৃষ্টির কারণে কৃষকেরা মরিচ চাষ করতে প্রতিকুলতায় পড়ে যান। ফলে প্রথম দফায় উৎপাদিত অধিকাংশ চারা নার্সারিতেই নষ্ট হয়ে যায়। আর যে সামান্য পরিমাণ চারা বিক্রি হয়েছে তাতে তেমন দাম পায়নি নার্সারি মালিকরা। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি দ্বিতীয় দফায় উৎপাদিত চারা দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। জাত ভেদে প্রতি হাজার চারা বিক্রি হচ্ছে ৯শ’ থেকে ১ হাজার টাকায়।
চারা উৎপাদন ও বিপণন কর্মযজ্ঞ চলবে নভেম্বর পর্যন্ত। নজরুল, ইসরাফিল, খোরশেদ আলমসহ বেশ কয়েকজন নার্সারি মালিক জানান, শাজাহানপুরের শাহ্নগর, কামারপাড়া, দুরুলিয়াসহ আশপাশের নার্সারিগুলোতে হাইব্রিড মরিচের মধ্যে কারিশমা, টাইগার, কিসমত, সুলতান, লাইলা, ১৭৫৩, লাইট মাস্টার, ময়নামতি, গ্রীন সুপার মরিচের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। রোগবালাই কম এবং ফলন বেশি হওয়ায় চাষিদের কাছে এসব জাতের চাহিদাও বেশি।

প্রায় ৪০ বছর আগে শাহনগর গ্রামে বাণিজ্যিক ভাবে সবজি চারা উৎপাদনের সূচনা করেন আঁখি বীজ ভান্ডার ও নার্সারির স্বত্ত্বাধিকারি আমজাদ হোসেন। তার হাত ধরেই ‘চারার নগর’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি পায় শাহনগর গ্রাম। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে আশপাশের গ্রামগুলোতেও গড়ে ওঠে চারা উৎপাদনের নার্সারি।
আমজাদ হোসেন জানান, মাঠ ফসলের চেয়ে চারা উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় দীর্ঘ কয়েক বছরে শাহ্নগর ও এর আশপাশের এলাকায় ছোট বড় ৩ শতাধিক নার্সারি গড়ে উঠেছে। এসব নার্সারিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করছেন ৩ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ। নার্সারি পল্লীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বীজ, কীট নাশক, সারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
শাজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমিনা খাতুন জানান, এ এলাকায় চারা উৎপাদন ও সবজি চাষে জড়িতরা লাভবান হচ্ছেন। তবে রোগমুক্ত সুস্থ সবল চারা উৎপাদনের জন্য দরকার উপযুক্ত মাটি ও দক্ষ কারিগর। তাপদাহ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ সব ধরণের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আধুনিক কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে বছর জুড়ে চলছে চারা উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ। এ কাজে উপজেলা কৃষি বিভাগ উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান ফরিদ জানান, জেলার শাজাহানপুর উপজেলার শাহনগর গ্রামে চাষিরা ৩০ থেকে ৪০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩০০টির বেশি নার্সারিতে আগাম সবজির চারা উৎপাদন করে যাচ্ছেন। শাহনগরের সবজির চারা দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। এখান থেকে জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, রংপুর, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, টাঙ্গাইল, ঢাকা, সিরাজগঞ্জসহ অন্যান্য জেলা থেকে ক্রেতারা চারা কিনতে আসেন।