বগুড়ায় বাহারি মাছের মেলায় কোটি টাকার কেনাবেচা

দীপক সরকার, বগুড়া: কবি সুকান্ত’র ভাষায় যেন-‘নতুন ফসলের সুবর্ণ যুগ আসে।’ ‘এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান’। নবান্নের বর্ণনা তিনি তাঁর ‘এই নবান্নে’ কবিতায় এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন। ‘রূপশালী ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ’ তেমনই হেমন্তের কার্তিক, অগ্রহায়ন আর জীবনানন্দ দাশ যেন একই সুত্রে গাঁথা। উজ্জ্বল রোদে সোনার ঝিলিক খেলে নুয়ে পড়া পুষ্ট ধানের শীষে। সে দৃশ্যে খুশির আভা ফোটে কৃষকের চোখে-মুখে। কাস্তের টানে মুঠি মুঠি কাটে ধানগাছ। এই বাংলায় হেমন্ত মানে নবান্নের উৎসব। আর নতুন ধানের গন্ধ। গ্রীষ্মের দাবদাহে রুদ্ররূপ, বর্ষায় বিরহিনী, শরতে স্নিগ্ধময়ী শারদলক্ষ্মী আর হেমন্তে কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা হৈমন্তিকা বয়ে নিয়ে আসে এক শুভবার্তা। হেমন্ত ঋতুর দিন-রাতের অবিশ্রান্ত শ্রমে কৃষকের ঘরে ওঠে সোনার ধান। বাংলার গ্রাম-গঞ্জ মেতে ওঠে নবান্নের উৎসবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পঞ্জিকামতে অগ্রহায়নের প্রথম দিনে একটি হলো নবান্ন উৎসব।
এ উৎসব উপলক্ষে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্নের আনন্দে মেতে উঠে। ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ মাছের মেলা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর মাছের সবচেয়ে বড় মেলা বসে শিবগঞ্জের উথলীতে। মাছের মেলা বসে জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ওমরপুর, রনবাঘা, হাটকড়ই, ধুন্দার ও দাসগ্রাম এবং শেরপুর উপজেলার বারদুয়ারীহাট, সকালবাজার, গোশাইপাড়া মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী হিন্দুরা নবান্ন উৎসব ঘিরে জেলার শিবগঞ্জের উথলী, রথবাড়ী, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদুল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, গণেশপুর, রহবল সহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে রয়েছে নানা আয়োজন। প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে জামাইসহ আত্মীয়স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠেন।

এই নবান্ন মেলার উদ্যোক্তা হলেও আশপাশের গ্রামের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে কেনাকাটা করতে আসে। এসব মাছের মেলার কথা বলা হলেও ক্ষেত থেকে নতুন তোলা শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে। এছাড়াও সেখানে নাগরদোলা, শিশু-কিশোরদের খেলনার দোকানও বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসানো হয় মেলা চত্বরে।
জনশ্রুতি রয়েছে ‘নবান্ন’ উপলক্ষে নতুন চালের তৈরি পায়েশ-পোলাও, পিঠা-পুলিসহ রকমারি খাদ্য-সামগ্রী পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। সামাজিকভাবে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পালন করা হয় এবং ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী নানা আচার-অনুষ্ঠান। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অন্ন লক্ষ্মীতুল্য। তাই তারা এ দেবীর উদ্দেশ্য পূজা-অর্চনার আয়োজন করে। এছাড়া, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাঁক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়জনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।

নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাঁককে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাঁকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাঁকবলী’। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। হিন্দু শাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুসারে নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্র মতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী এবং আদিবাসী সমাজেও নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি-নীতি, বিশ্বাস ও প্রথা অনুযায়ী নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও মুসলিম কৃষক সমাজে নতুন ফসল ঘরে ওঠার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্য বাড়ি বাড়ি কোরানখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, মসজিদ ও দরগায় শিরনির আযোজন করা হয়।

১৮ নভেম্বর শনিবার সকালে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় সরেজমিন দেখা যায়, ভোরেই মেলায় প্রচুর মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শতাধিক দোকানে দেড় থেকে শুরু করে ১৫ কেজি ওজনের বাঘাইড়, বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, ব্রিগেড কার্প, গ্লাস কার্পসহ নানা রকমের মাছ বিক্রি হচ্ছে। তবে দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি।
মেলায় বাঘাইড় ১৩’শ টাকা, বোয়াল ১৪’শ টাকা কেজি, রুই, কাতলা ও চিতল মাছ ৪৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ৩’শ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৩০০-৪৫০ টাকা দরে ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে, নবান্নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন আলু ২০০ টাকা কেজি, কেশুর ২০০ টাকা এবং মিষ্টি আলু ২১০ দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।

উপজেলার উথলী গ্রামের ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমি দাদার কাছ থেকে শুনেছি ‘প্রায় দুইশ বছরের’ পুরানো এ মেলা। রাত ১২টার পর থেকেই শুরু হলেও ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমে ওঠে এ মেলা।’

নিবারণ প্রামাণিক বলেন, ‘নবান্ন উপলক্ষে এখানে এ মেলা বসে। এদিন আমাদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের আগমনে মিলনমেলায় পরিণত হয়। মূলত তাদের জন্যই বড় বড় মাছ কিনতে মেলায় আসছি।’

মেলায় মাছ ব্যাবসায়ী পরিমল হালদার জানান, তিনি দুই লাখ টাকার মাছ এনেছেন। গতবারের তুলনায় এবার মাছের দাম একটু বেশি। তবুও বিক্রি বেশ ভাল হচ্ছে।

মাছ বিক্রেতা নারায়ণপুর গ্রামের আব্দুল ওয়াহাব জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত ৫ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
এ ছাড়াও নন্দীগ্রাম উপজেলার ওমরপুর ও রনবাঘা বাজারে ও শেরপুরের বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে বসেছে মাছের দোকান। দোকানগুলোতে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল ও সিলভার কার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ। এসব মেলায় এক কেজি থেকে শুরু করে ১৮ কেজি ওজনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

নন্দীগ্রামের ওমরপুর মেলায় মাছ কিনতে আসা জয় কুমার সরকার বলেন, নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর নন্দীগ্রামের বিভিন্ন বাজারে মাছের মেলা বসে। মাছের মেলাকে ঘিরে ওমরপুর বাজারে উৎসব মুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এবার মাছের দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে।

উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের ধীরেন চন্দ্র বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে অগ্রহায়ণ মাসের এইদিন মাছের মেলা বসে। দিন যতই যাচ্ছে এই মেলার ঐতিহ্য ততই বাড়ছে।’

মাছ বিক্রেতা মোস্তফা আলী, মিলন হোসেন বলেন, মেলায় ছোট-বড় মিলে প্রায় শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত ১০ থেকে ২০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন।

নামুইট গ্রামের অপর মাছ বিক্রেতা মিন্টু মিঞা বলেন, নবান্ন উৎসবকে ঘিরেই তারা মূলত মেলায় বড় বড় মাছ বিক্রি করতে আনেন।
নন্দীগ্রামের রনবাঘা হাটের ইজারাদার শফিকুল ইসলাম শিরু বলেন, এ হাটে প্রতিবছর নবান্ন উপলক্ষে অতুল মাছ ওঠে, প্রায় অর্ধ কোটির উপরে মাছ বিক্রি হয় এ মেলাতেই।

জেলার শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক বলেন, প্রায় তিনশো বছরের পুরাতন এই মেলায় সূর্যোদয়ের পর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত মাছ কেনাবেচা হবে। এবার মাছের আমদানি ভালো। আশা করি এ বছর এখানে কোটি টাকার ওপরে মাছ কেনাবেচা হবে।’

এ প্রসঙ্গে শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো.আব্দুর রউফ বলেন, নবান্নের এ মেলায় যেন কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয় তার জন্য পুলিশ বাহিনী সজাগ রয়েছে।

Comments (০)
Add Comment