শিশুর হারপেটিক জিনজিভাইটিসে করণীয়

আমাদের দেশে দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের একটি খুবই পরিচিত সমস্যা হল প্রাইমারী হারপেটিক জিনজিভোস্টোমাটাইটিস। অল্প বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এ রোগটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে। যদিও মধ্যবয়সী বা বয়োবৃদ্ধরাও আক্রান্ত হয়, কিন্তু কম বয়সী শিশুদের ভোগান্তির মাত্রা অনেক বেশি হয়। এটি মুখের ভেতরে দাঁতের মাড়ি ও মিউকোসার ক্ষত সৃষ্টিকারী ভাইরাস জনিত সংক্রামক রোগ। হারপিস ভাইরাস হোমিনিস নামক জীবাণুর সংক্রমণে রোগটি মানবদেহে ছড়ায়।

মাতৃদুগ্ধের সাথে শিশুর দেহে অ্যান্টিবডি স্থানান্তর হওয়ায় জীবনের প্রথম বছরে সাধারণত এ রোগটি তেমন দেখা যায় না। শহুরে জনগোষ্ঠীর শতকরা এক শত ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে এ জীবাণুটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বয়স্ক ব্যক্তির দেহে ভাইরাসটি ¯œায়ুর গোড়ায় সুপ্তাবস্থায় বছরের পর বছর থাকে পারে। যখনই কোনো ধরনের মানসিক পীড়ন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির সংস্পর্শ ঘটা, জ্বর ইত্যাদি কারণে শারীরিক দূর্বলতা প্রকাশ পায় তখনই এ ভাইরাসটি সংক্রমণ ঘটানোর জন্য সক্ষমতা লাভ করে।

মানব শরীরে ভাইরাসটি ড্রপলেট-এর মাধ্যমে প্রবেশ করে। সর্বপ্রথম যখন ভাইরাসটি শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে এর এক সপ্তাহ পর উপসর্গগুলো প্রকাশ পায়। শিশুদের দেহে ১০০-১০২ ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর ওঠে, মাথা ও মুখ বিবরের ভেতরে সামান্য থেকে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথায় নিচের চোয়ালের দুই পাশের লিম্ফগ্রন্থিগুলো ফুলে ওঠে। খাবার খেতে অসুবিধা হয় এবং মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। দাঁতের মাড়ি ফুলে গিয়ে সুই-এর মত মাথাযুক্ত তরল পদার্থে পূর্ণ গুটি গুটি তৈরি হয়।

গুটিগুলো প্রধানত মাড়ি; এছাড়া জিহ্বা, জিহ্বার নিচের অংশ, উপরের তালু, গাল ও ঠোটের ভেতরের অংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে। গুটিগুলোর ওপরে হালকা হলুদ বা ধূসর আবরণ থাকে। গুটি তৈরি হওয়ার কয়েক ঘন্টা পর সেগুলো ফেটে গিয়ে তীব্র ব্যথাযুক্ত ঘা সৃষ্টি হয়। ঘা এর চারদিক লাল হয়ে ফুলে ওঠে।
এ সময় শিশুরা খুব অস্বস্তি বোধ করে, খাওয়া ও খেলাধুলা ছেড়ে দেয়। অভিভাবকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। বিভিন্ন কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কেউ কেউ দিশেহারা হয়ে হাতুড়ে চিকিৎসকের পরামর্শে তার শিশুকে বিভিন্ন দামি ব্রান্ডের ওষুধ খাওয়াতেও পিছপা হন না; যদিও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে খুব বেশি।

আবার কেউ কেউ শিশুর মানসিক ব্যাপারে লক্ষ্য না রেখে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হন্যে হয়ে ওঠেন। এতে শিশুর মানসিক যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়; শিশু ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবে সত্যিটা হল যে, এর কোনো শতভাগ কার্যকরী চিকিৎসা নেই। দুই সপ্তাহ পর ক্ষতগুলো আপনা-আপনিই ভাল হয়ে যায়।

তাই অত্যধিক দুশ্চিন্তারও কোনো কারণ নেই। এ অবস্থায় শুধু কষ্ট প্রশমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই হয়; যেমন: শিশুকে বেড রেস্টে রাখা, হাসি-খুশিতে রাখার চেষ্টা করা, যেহেতু খাবার খেতে কষ্ট হয় তাই নরম খাবার দেয়া, অতিরিক্ত জ্বর ও ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেয়া, কুসুম গরম পানিতে নরম পাতলা সুতি কাপড় ভিজিয়ে মুখ বিবর পরিস্কার করে দেয়া। শিশুর বয়স ছয় বছরের বেশি হলে মাউথওয়াস দিয়ে দিনে দুই বা তিন বার কুলকুচি করানো যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, যে কারও পরামর্শে যেখান-সেখান থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টি ভাইরাল জাতীয় ওষুধ নিয়ে সেবনেও এ ভাইরাসটি মানবদেহ থেকে চিরতরে বিতারিত হয় না বরং সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যেহেতু এমনিই এ রোগটি ভাল হয় তাই অতিরিক্ত পরিচর্যারও প্রয়োজন নেই। হাতের নাগালের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্যারাসিটামল ওষুধ নিয়ে প্রশমন চিকিৎসাই রুখতে পারে শিশুর ভবিষ্যত জীবনের বড় ক্ষতি।

অতএব, শিশুর প্রতি একটু খেয়াল রাখলেই প্রতিরোধ করা যায় প্রাইমারী হারপেটিক জিনজিভাইটিস। তাই এ রোগে অস্থিরতা ও ভয় নয়, শিশুর প্রতি স্বস্তিরতা জরুরি।

 

ডা: মো. সিকান্দার আবু জাফর
সহকারী তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী