আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস

0 ২৮৮

বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, পুঁজিবাদের শোষণের কারণে নারীর অবস্থান ক্রমশ নাজুক ও প্রান্তিক অবস্থানে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় নারী দিবসের সূত্রপাত এবং প্রাসঙ্গিকতা আরও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে এ বছর দিবটির প্রতিপাদ্য করেছে- ‘নারী নেতৃত্বের বিকাশ : সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ার অঙ্গীকার’। বাংলাদেশে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’।

 

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরি-বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের উপর দমন-পীড়ন চালায় মালিকপক্ষ। নানা ঘটনার পর ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি নারী দিবস হিসেবে পালন করছে।

 

সর্বক্ষেত্রে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক তাৎপর্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে পালিত এ দিনটিকে ঘিরে গেল বছর ঠিক একই সময়ে দেশের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বকারী বিশিষ্ট নারীরা নিজেদের অভিমত দিয়েছিলেন। তাদের সেই অভিমতগুলোই আজ আবারও পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

 

সেলিনা হোসেন
লেখক, সাহিত্যিক
সমাজে নারী-পুরুষ সমতা কিছুটা অর্জিত হলেও পূর্ণমাত্রায় তার অর্জিত হয়নি। কারণ, সমতার জায়গাগুলোতে কোন কোন পুরুষের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, নারীকে সমতার জায়গায় পৌঁছাতে দেয়নি। সমাজে যদি নারী-পুরুষ সমতা বিদ্যামান থাকতো, তাহলে নারী নির্যাতনের এত দুর্ঘটনা ঘটত না। সমাজে পুরুষের নৈতিকতার দিকটি এতটাই প্রধান্য পায় যে, নির্যাতনের বিষয়টি পুরুষেরা গ্রাহ্যই করে না। চোখের সামনে এত এত ভয়াবহ ঘটনা প্রতিদিন দেখার পর কিভাবে বলা যায়, সমাজে নারী-পুরুষের সমতা অর্জিত হয়েছে?

 

রাশেদা কে চৌধুরী
পরিচালক
গণসাক্ষরতা অভিযান
পৃথিবীর কোন দেশেই নেই নারী-পুরুষ সমতা। কারণ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে কেউ বের হয়ে আসতে পারেনি। যদি তাই হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে হিলারি ক্লিনটন কি জিততে পারতেন না? সে দেশে নারী প্রেসিডেন্ট হলো না কেন? ওই আদর্শিক জায়গা থেকে কাজ করলে সমতা আসত বা সমতা প্রতিষ্ঠিত হতো। তবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অনেক দেশ যেমন- নরওয়ে, সুইডেনসহ ডেনমার্কে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। ওই সব দেশের মতো আমাদের দেশও যদি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে সবাই এগিয়ে যেতে পারত সমান তালে।

 

তবে আমাদের দেশের একটি ভালো দিক হলো, অর্জনের জায়গা কিছু যুক্ত হয়েছে। তবে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে নারীরা অনেক এগিয়ে। বলতে গেলে দেশের সর্বত্রই বিদ্যমান নারীর দৃপ্ত পদচারণা । সামাজিক-রাজনৈতিক, কিংবা অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশের নারীরা। বলা যায়, প্রাথমিক লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। আবার গত তিন দিনের পরিসংখ্যানে এসেছে, উচ্চতর পর্যায়ে নারীদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে রয়েছি। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেখানেই নারীরা সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই নিজেদের পেশাগত দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে তারা।

 

তারা উজ্জ্বল মিশনে, বিমানে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে। যদিও পেশাগত দায়িত্বের সেই ক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের বরাবরের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি! তারা আরও এগিয়ে আসতে পারত! সবগুলো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অঙ্গীকার তাদের দলে এক-তৃতীয়াংশ নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় এখনও পাকাপোক্ত হয়নি। এখানে অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, পেশীশক্তির কাছে নারীরা জিম্মি। কেবল সেখানেই কেন? রাষ্ট্রের একদম ক্ষুদ্র ইউনিট পরিবারেই বৈষম্য’র শিকার নারীরা। ৯০ পরবর্তী সময় থেকে তিন দশক ধরে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী নারীরা। তার পরেও দেশে নারী-পুরুষ সমতা কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্জিত হয়নি, কারণ এটা সরকারের একার পক্ষে কাজ নয়। তাই শেষ করতে চাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টি চরণ দিয়ে- ‘আমার কবিতা, জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী’।

 

ড. ফাহমিদা খাতুন
অর্থনীতিবিদ
নির্বাহী পরিচালক
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
নারী-পুরুষের সমতা পৃথিবীর কোন দেশেই অর্জিত হয়নি। আমাদের দেশে হওয়ার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। এর পেছনে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে এখনও নারীদের প্রায় একাই ঘর-সংসার সামলাতে হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করে চাকরিতে ঢোকার পর অনেককেই কাজ এবং সংসারের ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হয়। বিশেষ করে ছোট বাচ্চা থাকলে তাকে নিরাপদ কোথাও রাখার ব্যবস্থা না থাকলে নারীদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এছাড়াও যাতায়াত, আবাসন এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণেও নারীরা বাইরে কাজ করতে পারেন না।

 

আর যারা স্বনিয়োজিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাদের জন্য তথ্য, অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি মূলধনের অভাব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে নারীরা তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষা এবং সীমিত দক্ষতার কারণে নিম্ন আয়ের কাজগুলো করে থাকেন। নারীরা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি শিক্ষায়ও পিছিয়ে। তাই সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরা এখনও সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো নেতৃত্ব পর্যায়ের পদগুলোতে খুব কমই আসতে পারছেন। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণে নারীদের অবহেলার চোখে দেখা হয়। তবে তার সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধও নারীদের জন্য বাধা হয়ে আছে। বেশিরভাগ মানুষই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। নারী এবং পুরুষ উভয়ই নারীদের দক্ষতা এবং ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেন। শিক্ষিত পুরুষরাও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। এটা তাদের মনের গভীরে প্রথিত হয়ে আছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের কাছ থেকেও নানারকম বাধা পেয়ে থাকেন। নারী-পুরুষ অসমতার আরেকটি কারণ কারণ হচ্ছে, নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অভাব। রাজনৈতিক দল, সংসদ, দেশ পরিচালনায় আরও বেশি করে নারী না এলে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়বে না।

 

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের সংস্কৃতিতে ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা দেখে এবং শিখে বড় হয় যে, নারীরা হচ্ছে দুর্বল, নারীদের সব কিছু করার ক্ষমতা নেই। সবকিছু পাওয়ার অধিকার নেই। পরিবারে এবং স্কুলে তাদের নারী-পুরুষের সমতার বিষয়ে শিক্ষাপ্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

প্রকৃতপক্ষে, নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, অন্যদিকে সমাজ ও পরিবারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য শাস্তির বিধান থাকা এবং তা কার্যকর করা। নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের জন্য আমাদের দীর্ঘ পথ পার হতে হবে।

 

সুসানে গীতি
মেজর জেনারেল
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ নারী ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, জাতীয় সংসদের উপনেতা ও স্পিকারও নারী। মন্ত্রিসভায় রয়েছেন চারজন নারী। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে, যেমন সচিব, উপাচার্য, নির্বাচন কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে আমরা নারীদের দেখতে পাচ্ছি।

 

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে ৫০ জন সংসদ সদস্য আছেন। ২০ জন নারী সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্য পদে আসীন। ইউনিয়ন পরিষদে প্রায় ১২ হাজারের অধিক নারী সদস্য নির্বাচিত। প্রায় ৫০০ উপজেলায় একজন করে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। পাশাপাশি সেনা-নৌ ও বিমানবাহিনীতেও নারী সদস্যরা নিবেদিতভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ পুলিশে নারী সদস্যরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে মহিলা পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের দুই নারী নিশাত মজুমদার ও ওয়াসফিয়া নাজরীন হিমালয় জয় করেছেন। বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলসহ ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সফল পদচারণা।

 

দেশের নারীরা আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কৃষিতেও নারীদের অবদান উল্লেখযোগ্য। নারী শিক্ষায় জেন্ডার সমতা অর্জনসহ বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে নারীদের সফলতা এক অনন্য অধ্যায় রচনা করছে। নারী-পুরুষের সমতা অর্জন একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই এটি আমরা অর্জন করতে চলেছি।

 

শিপা হাফিজা
নির্বাহী পরিচালক
আইন ও সালিশ কেন্দ্র
প্রশ্ন হলো, নারী-পুরুষের সমতাটা কোথায় হলো? নারী-পুরুষ কি সমান এ দেশে? দেশে নারীরা এখনও সম্পদের মালিক হতে পারেনি, চাকরি থেকে শুরু করে পেশাগত চাকরির ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা তেমন উঠে আসছেন না। আমরা যদি দেখি, আমাদের বাড়ির ভেতরের অবস্থা, পারিবারিক কলহ বা রাস্ত-ঘাটে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ এগুলোও প্রতিনিয়ত হচ্ছে এবং বেড়েই চলেছে। আর এ বিষয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই নারীর বিপক্ষেই কাজ করছে। সেটা শিক্ষার ক্ষেত্রে বলেন অথবা নীতি-নির্ধারণীর ক্ষেত্রেই বলেন- সবই নারীর বিপক্ষে কাজ করছে। আবার, আমরা যদি আইনকানুন বলি, সেটাও নারীর পক্ষে নেই। দেশে মহামারীর মতো ধর্ষণের সংখ্যা বাড়লেও, কোন আইন নেই যা দিয়ে সঠিক বিচার হবে। যে আইন রয়েছে তা অনেক পুরনো, যুগোপযুগী নয়। বাল্যবিবাহ প্রচণ্ড হারে হচ্ছে কিন্তু বাল্যবিবাহের আইনের মধ্যে এমন কিছু বিধান রয়েছে যা আসলে আমাদের দেশের নারী ও শিশুর জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ এবং তাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও ধর্মীয় প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে আমরা পক্ষপাত দেখাচ্ছি, তাতে কিন্তু নারীর জন্য বিপদ ছাড়া কোন ধরনের সহযোগিতাই হচ্ছে না। কাজেই আপনি একটি একটি করে প্রতিটি বিষয়ে সেটা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ই হোক বা আইনকানুনের বিষয়ই হোক বা আমাদের প্রতিদিনের চলাফেরায় কোথাও দেখিনি নারীর জন্য সমতার বিষয়টি। বিশেষ করে মন-মানসিকতা, এটার পরিবর্তন না হলে আসলে কোন কিছুই কাজে আসবে না। আপনি শিক্ষা বলেন, সচেতনতা বলেন, আইন বলেন; কোন কিছুই আসলে কাজে আসে না, যদি না সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো যায়।

 

আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মননশীলতাকে আরাও বেশি সনাতনী করে তোলে। কার্যত কোন শিক্ষার্থী এই কথাটুকু মনে বা মননে ধারণ করে না যে, নারীর প্রতি সহিংসতা একটি ঘৃণিত কাজ এবং এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারী কিংবা অন্য যে কোন লিঙ্গের মানুষ বিপদে পড়লে কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীকে দোষারোপের মধ্য দিয়ে এ ধরনের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করা হয়।

 

তবে হ্যাঁ, এতকিছুর পরেও নারীর অগ্রগতি হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে গ্রামে গেলে গবাদি পশু দেখা গেলেও নারীদের দেখা যেত না। কিন্তু নারীরা এখন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন, ছড়িয়ে পড়েছেন সব ক্ষেত্রে। তবে সে ক্ষেত্রগুলোতে তারা সমতার হিস্যা পাচ্ছেন না, বৈষম্যের রোষানলে পুড়ছেন। আমাদের নারী প্রতিনিধিরাও কিন্তু এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। তারা নিজেদের রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন, সেখান থেকে বেরিয়ে নারীর পক্ষে কথা বলছেন না বা বলতে পারছেন না। যদিও এ বিষয়ে বরাবরের মতোই সরব আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এটা কারও একার কাজ নয়, হওয়া উচিত নয়।

 

পরিশেষে, সমাজে নারী-পুরুষের সমতা কেন অর্জিত হচ্ছে না, নারী-পুরুষ সমতার অন্তরায় হলো আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোথাও নারীর প্রতি সহিংসতার যথাযথ বিচার না হওয়া। ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা এবং নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর পক্ষে শক্ত ভূমিকা পালনের কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা। এগুলো যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে আশা করা যায়, দেশ নারী-পুরুষ সমতার পথে অনেকটাই এগিয়ে যাবে।

 

ড. নাদিয়া বিনতে আমিন
প্রেসিডেন্ট
ওয়েন্ড (ওমেন এন্ট্রেপ্রিনিয়ার্স নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন)
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস স্বীকৃতি পাবার পর থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী দিবস প্রতি বছর পালিত হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করে। পাশাপাশি সারা দেশে জেলা- উপজেলা প্রশাসন, সরকারি ও বেসরকারি অনেক সংগঠন দিবসটি পালন করে থাকে।

 

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রসর হয়েছে। বিশ্বে আজ নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ রোল মডেল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মহান সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে নারীর সম অধিকারের কথা এনেছেন। যারসূত্র ধরে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন শুরু হয়েছে।

 

বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারে উন্নয়নের যে ১০টি অগ্রাধিকারমূলক উদ্যোগ রয়েছে তার মধ্যে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ অন্যতম। এছাড়াও এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার মধ্যে ৫নং লক্ষ্যমাত্রাটি নারীর সমতা এবং ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ লক্ষ্যমাত্রাকে অর্জন করার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।

 

নারীকে আরও অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে এগিয়ে নেয়ায় জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জেন্ডার রেসপেনসিভ বাজেট প্রণয়ন করেছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সমাজের সব শ্রেণীর নারীদের এগিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল, হাওরাঞ্চল ও সমাজের অবহেলিত সব নারীদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হবে বলে আমি আশাকরি।

 

নারীরা আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আবার বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্রে সম্পৃক্ত এগিয়ে যাওয়া এ নারীদের মধ্যে উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যদিও উচ্চপর্যায়ে তাদের উঠে আসার হার কম, তবুও তারা উঠে আসছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো উদ্যোক্তারা উচ্চপর্যায়েও চলে আসবে। তবে, সেটা সময় সাপেক্ষ।

 

নারী নির্যাতন মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতে একটি আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখি। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করে সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে আলোকিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী।

 

ফরিদা ইয়াসমিন
সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
দেশে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। এ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশ যদিও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে আজ। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিচারপতি হচ্ছেন নারী, সচিব পর্যায়ে আছেন অনেক নারী। নারীদের সামগ্রিক অগ্রগতি দৃশ্যমান।

 

নারীরা এগুচ্ছে বলেই দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ শীর্ষে। কিন্তু সমতার জায়গাটায় যেতে আরও পথ হাঁটতে হবে। এখনও নারীরা ঘরে-বাইরে নির্যাতিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করে সামগ্রিকভাবে নারীদের এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকলেও চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নীতিনির্ধারণী পর্যায় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। তাই বলা যায়, সামগ্রিকভাবে নারীদের যে অগ্রগতি, সেটা এখনও হয়নি।

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, পুরুষরা কর্মক্ষেত্রে আসার অনেক পরে নারীরা কাজের খাতিরে ঘর থেকে বের আসা শুরু করে। বাংলাদেশে আরও অনেক পরে নারীর কর্মক্ষেত্রে পা রাখা। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু নারীদের কথা বিশেষভাবে চিন্তা করলেন। সমাজে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অগ্রগতি না হলে উন্নয়ন সম্ভব নয়- এ চিন্তা থেকেই তিনি সেসময় অনেকগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু আমাদের সংবিধানে নারীর সমঅধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি সংসদে বিশেষ ব্যবস্থায় নারীর জন্য কোটা- এসব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেশের পরবর্তী সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার নারীদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী নারীর উন্নয়নের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছেন বলেই কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা খানিকটা এগিয়েছেন।

 

তবে সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা ইতিবাচক নয়। নারীর প্রতি মানুষের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক বলেই তার জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু কিছু ব্যবস্থা নিলেও এখানে পরিবারের সহযোগিতা একান্ত জরুরি। সামগ্রিক অর্থে, নারীর বিষয়ে পরিবার-সমাজ উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গির পরবির্তন হতে হবে। আমার কথা হলো, আস্তে আস্তে এ পরিবর্তনগুলো হবে এবং হচ্ছেও। তবে সার্বিকভাবে এ পরিবর্তন হওয়ার জন্য আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। আর তাই সবক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য আমাদের আরও পথ পাড়ি দিতে হবে।

 

অধ্যাপক ড. উম্মে শাহনাজ পারভীন
হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট
ডিপার্টমেন্ট অব মাইক্রোবায়োলজি
ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ
দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তবে জটিল ও পুরোনো কিছু সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে এখনও গুরুতর কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো নারীর প্রতি সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। যার ফলে নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন দুরূহ বলে প্রতিভাত হচ্ছে।

 

দক্ষতা ও আত্মনিবেদনের জায়গা থেকে দেশের চিকিৎসা সেবা খাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারী চিকিৎসকের অংশগ্রহণ ঈর্ষণীয় হলেও এই নারীদের ৯৬ শতাংশই বিশেষভাবে স্ত্রী-প্রসূতিরোগ বিষয়ে দক্ষ। আবার এমবিবিএস পাস করা নারীদের ৯১ শতাংশই স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি-বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আহগ্রী। সমাজ, পরিবার ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা নারী চিকিৎসকদের এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরোক্ষভাবে বাধ্য করে থাকে। যদিও সমাজে নাগরিক ও মানুষ হিসেবে নারী- পুরুষ উভয়েই সমান, তবুও মেধা থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে নারীরা পুরুষ চিকিৎসকদের সঙ্গে সমতা আনার দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে।

 

জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ ও আইসিডিডিআরবির’র যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক রোগীই এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন যে, নারী চিকিৎসকের তুলনায় পুরুষ চিকিৎসক বেশি দক্ষ। আবার ক্ষেত্র বিশেষে অনেক পুরুষ সহকর্মীরাও মনে করেন, অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফলের অধিকারী তার নারী সহকর্মী কম দক্ষতার অধিকারী। এমন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি আরও একটি আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি এ সেবা খাতে নারীর সমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

 

আর সেটা হলো, চিকিৎসা বিদ্যায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলেও এমবিবিএস শেষ করেও অনেক নারী এই পেশা চর্চার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান বা পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে পেশা ছেড়ে দেন। তাই চিকিৎসা বিদ্যায় ছাত্রী বৃদ্ধির অনুপাত আর নারী চিকিৎসকের অনুপাতের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান হওয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান অসংগতিগুলো দূর করার লক্ষ্যে পুরুষের মতোই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মধ্য দিয়ে একসঙ্গে কাজ করে চিকিৎসা সেবায় প্রকৃত সমতা ও উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। অতীতের তুলনায় দেশের আর্থ-সামাজিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধারা আগামী দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে- আজকের এই বিশেষ দিনে এটাই প্রত্যাশা।

 

লাকি ইনাম
পরিচালক
শিশু একাডেমি
নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে যে অধিকার প্রতিষ্ঠা এটাতো অনেকদিন ধরেই একটা প্রচেষ্টার মধ্যে ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় বিগত কয়েক বছরে নারীদের প্রতিস্থাপন, বিভিন্ন সেক্টরে, বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সবদিকেই নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। এখন যদি আমরা পেছনে ফিরে দেখি, তাহলে দেখবো খুব দ্রুতই বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতি হয়েছে, নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

 

নারীর ক্ষমতায়ণের ব্যাপারে আমরা যে এগিয়ে গেছি সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর এভাবে যদি বলা হয় আমরা আরো কতটা এগিয়ে যাবো সেটা কিছুটাতো সময়েরই ব্যাপার। যদি অগ্রগতির একটা ধারাবাহিকতা তৈরি হয়ে যায় সেটাকে রোধ করা যাবে না। সেই জায়গাটায় আমরা এসে পৌঁছেছি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা সেই জায়গাটিতে এস পৌঁছে গেছি। এবার জাতিসংঘ নারী দিবসের যে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে তার স্লোগান – অহ বয়ঁধষ ড়িৎষফ রং ধহ বহধনষবফ ড়িৎষফ. অর্থাৎ নারীর যে অধিকার সারাবিশ্ব তা অনুধাবন করতে পেরেছে। সেটা শুধু নারীরাই নন, পুরুষরাও, সমাজ, রাষ্ট্র এখন এটা অনুধাবন করতে পারছে যে, নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল, সে অধিকারটা তারা প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে।

 

এবারে ২০২০-এর যে প্রতিপাদ্য বিষয় সেটা আমি মনেকরি খুবই যুক্তিসংগত। নারী-পুরুষ সমতার বিষয়ে আমরা প্রত্যাশিত দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। একেবারে পুরোপুরি হয়েছে সেটা তো অবশ্যই বলা যাবে না। তবে আমরার সে ধারাবাহিকতার দিকে অনেকদূর এগিয়ে গেছি। নারী-পুরুষের সমতার দিকে আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এ ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অচীরেই আমরা নারী-পুরুষ সমতা অর্জন করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

 

নারী শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের বিষয়টা আমাদের কিন্তু সেটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিশেষ কিছু স্তর পার হতে হয়, সহায়ক পরিবেশের অভাবে আমাদের গ্রামীণ বা প্রান্তিক নারীরা সেটি পার হতে পারছে না। ফলে, আমাদের নারী-পুরুষ সমতাটা অনেকটা শহরকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

 

আমরা যখন বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যাই তখন দেখি নারীরা সরকারি-বেসরকারি সব উচ্চপর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর অন্যতম প্রধান একটি কারণ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে খুবই সচেতন। আমার দৃষ্টিতে তিনি প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাচ্ছেন যোগ্যতা অনুযায়ী নারীদের প্রতিস্থাপিত করা জন্যে। আর সে ধারাবাহিকতায় দেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, যা ত্বরান্বিত করছে দেশের নারী-পুরষ সমতার ক্ষেত্রকে।

 

রাফাহ নানজীবা তোরসা
মিস ওয়ার্ল্ড-বাংলাদেশ ২০১৯, সামাজিক আন্দোলন কর্মী
নারী-পুরুষ সমতা অর্জিত হয়েছে কি? এ প্রশ্ন দ্বারা আসলে বোঝা যায় যে, নারী-পুরুষ সমতা এখনও অর্জিত হয়নি। কারণ যখন কোন কিছু অর্জিত হয়ে যায় তখন আমরা সে বিষয়ে আর জিজ্ঞেস করি না। আমার কাছে যেটা মনে হয় সেটা হচ্ছে- যদিও আমরা নারীর ক্ষমতায়নের পথে অনেকখানি হেঁটেছি, যার উদাহরণ দেশের শীর্ষস্থানীয় পদগুলেতে নারীদের বিচরণ। কিন্তু তারপরেও আমরা যদি সমতার জায়গায় আসি, তাহলে আমরা এখনও অনেকখানি পিছিয়ে আছি। কারণ, যদি আামি পরিসংখ্যানগত দিকে যাই দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে লিঙ্গ সমতা আসতে সময় লাগছে প্রায় ১৭০ বছরেরও বেশি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ বিষয়টি একেবারেই নতুন। আমি যদি এত অল্প সময়ে প্রত্যাশা করি, যে আমরা সমঅধিকার বা সমতার জায়গাটা নিশ্চিত করতে পেরেছি, সেটা আসলে একটু বেশিই প্রত্যাশা।

 

হ্যাঁ, তবে আমরা যে অগ্রসর হইনি তেমনটা নয়, অনেকখানি অগ্রসর হয়েছি, তবে পারি দিতে হবে আরো বহুদূর। আমাদের জেন্ডার ইকুয়ালিটির (লিঙ্গ সমতা) জন্য জেন্ডার ইকুইটি (লিঙ্গ ন্যায্যতা) বুঝতে হবে। আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, আমরা ন্যায্যতার হিস্যা বুঝে পাচ্ছি কিনা, পরে আমরা সমতার দিকে ধাবিত হবো।

 

সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্পিকার সবাই নারী, এছাড়াও দেশের প্রতিটি খাতে নারীদের পদচারণা ইঙ্গিত করে যে, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। লিঙ্গ সমতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮ এবং এশিয়ায় শীর্ষ (সম্ভবত)। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত আমরা সমতা অর্জন করতে পরিনি এবং আমরা যদি এটা ধরে নেই অল্প কিছুদিন বা কয়েক বছরের মধ্যে এটা পারব, সেটা হয়তো সম্ভব নয়। হয়তো আরও কয়েক প্রজন্মেও আমরা লিঙ্গ সমতা দেখতে পাব না। কিন্তু আমরা যে এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাওয়ার পথে হাঁটছি সেটাই ইতিবাচক দিক।

 

আমি মনে করি সমতার ধারণাটা শুধু একটা শ্রেণির কাছে পৌঁছেছে। হয়তো আপনি আমি বুঝেছি, কিন্তু আমরা যদি গ্রামীণ সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তারা হয়তো জানেনই না যে, সমতার বিষয়টা কি। সেই সমাজের নারীরাও জানেন না যে, তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ইচ্ছে করলে তারও যে অনেক কিছু করতে পারেন, সেটা তারা বিশ্বাস করতে পারে না। মূল কথা হচ্ছে, সমতার যে ধারণা সেটা যে অগ্রগামী হয়নি তা নয়, বরং আমরা এটা ঠিকমত পৌঁছে দিতে পারিনি। এখনও দেখা যায় বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত সিট নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এটা আসলে সমতা নয়, ন্যায্যতার বিষয়। সমতা অর্জনের আগে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় সমতা অর্জিত হবে না। আর শুধু এটা সমতার জায়গা না, সমতার জায়গায় হলো- সুযোগ দেয়া, ন্যায়বিচার পাওয়া, সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিভাবে নারীকে এগিয়ে নেয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে, লিঙ্গ সমতা যে শুধু নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়, এর বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন, তাদের কথাও মাথায় রাখতে হবে।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.