কৃষাণ কুমার
পরম মমতার চাদর গায়ে মায়ের কোলে শুয়ে থাকা আতুড়ে শিশুর মতো
সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ভূখণ্ড তখন ঘুমদেবীর কোলে ঘুমন্ত ।
রাত্রির সমস্ত কোলাহলও সেদিন যেন তন্দ্রায় ঢুলে পড়েছিল খাটুনে চাষার মতো অবসাদে ,
হয়তো সেদিন ইন্দ্রসভায় সংজ্ঞা হারিয়েছিল তেতত্রিশ কোটি দেবতা ,
অসুরের স্পর্ধা দেখে অপ্সরী কিন্নরীরা দাঁত কেলিয়ে ডাইনীর হাসি হেসেছিল আহ্লাদে ,
শয়তান সেদিন হন্যে কুকুরের মতো লেলিয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া নামের একটি নরখাদক,
সারাদেশের প্রধান শহরগুলোতে শুরু হলো মৃত্যুর মহোৎসব,
নিরবে নির্বিচারে ঘুমন্ত নিরীহ নিরাপরাদ মানুষের বুকের উপর ,
মাথার খুলিতে চালানো হলো গুলি ।
নৃশংস নির্মম গণহত্যার দামামায় চুপসে গেল পৃথিবী,
মানুষের বিভৎস মৃত্যুর আর্তনাদ শিৎকারে আকাশের সমস্ত নক্ষত্র পলাতক।
প্রচণ্ড শঙ্কায় থরথর কাঁপছিল বুকের বাতাস ,
মৃত্যুর মিছিল নেমেছে শহরে
দানবের মতো উদ্ভট রাতের অন্ধকার যেন প্রকাণ্ড থাবা বিস্তার করে খামচে ধরেছে জননীর কোমল শরীর ।
সেদিন বাকশক্তি রোহিত হয়ে গেছিলো সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ।
তখন শেষ প্রহর
চোখে দেখার মতো একটুও আলো ছিল না অবশিষ্ট ,
মৃত্যু মুখর সে রাতে শুধু এক জোড়া চোখে জেগেছিল প্রতিশোধের স্ফুলিঙ্গ ,
একটিমাত্র কণ্ঠস্বর দুঃসাহসিক গর্জে উঠেছিল চরম ক্ষোভে আর ঘৃণায়;
একজোড়া চোখের রৌদ্রছটা জাগিয়ে তুলেছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত এই জনপদ।
পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি বৈরী সময়ের বিপরীতে একটিমাত্র বুক টান টান করে উচ্চারণ করেছিল স্বাধীনতার মহামন্ত্র,
সেই মন্ত্রের দীক্ষায় বোবা পেয়েছিল বিদ্রোহের ভাষা,
নিরীহ দুর্বলের বুকে জাগিয়েছিল মুক্তির মিছিলে বুক চিতিয়ে মরবার দুঃসাহস ।
শহরের অলিতে গলিতে বুলেট ঝাঁঝরা ছিন্ন ভিন্ন লাশ ,
এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো রক্ত মাংস ,
শোকের বদলে শাণিয়ে দিল মনস্তাপ ।
শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ , শুরু হলো ঘাতক নিধন যজ্ঞ
এইদিনেই স্বাধীনতা শব্দটি বুঝতে শিখেছিল , স্বাধীন পথে চলতে শিখেছিল আমার পূর্বপুরুষ,
স্বাধীন আশায় জ্বলতে শিখেছিল বাঙালি ,
তাই চেতনার বহ্নিতে চির ভাস্মর ছাব্বিশে মার্চ ।