এস এম রেজাউল করিম, ঝালকাঠি : ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মাহতাব হোসেন টিটু মাত্র সাত বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সাত বছরে নানা অবৈধ পন্থায় আয় করা টাকায় তিনি বরিশালের রুপাতলী এবং নলছিটি শহরে একাধিক ভবন নির্মান করেছেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর টিটুর দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বরিশাল দুর্নীতি দমন কমিশনেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। মাহতাব হোসেন টিটু নলছিটি উপজেলা ছাত্রলীগের সাইফুল-টিটু কমিটির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। জেলার প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকায় সাধারন শিক্ষকরা তার রিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাচ্ছেনা।
অভিযোগে প্রকাশ, নলছিটি উপজেলার দেলদুয়ার গ্রামের ফজলুর রহমানের ছেলে ও সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মাহতাব হোসেন টিটু মাহতাব হোসেন টিটু ২০১২ সালের আগস্ট মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন। সহকারী শিক্ষকের চাকুরীতে যোগদান করেই মাহতাব হোসেন টিটু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নলছিটি উপজেলায় একটি শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করেন নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক ছাত্রনেতা মাহতাব হোসেন টিটুর মাধ্যম ছাড়া শিক্ষকদের বদলী, ছুটি, ইনক্রিমেন্ট কিছুই হতে পারে না। শিক্ষা অফিস থেকে যে কোন ধরনের বরাদ্দের অর্থ ছাড় করাতে টিটুকে নিদৃষ্ট হারে টাকা দিতে হয়। আর এসব টাকা থেকে একটি অংশ চলে যায় নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নেক নজরে থাকার কারনে মাহতাব হোসেন টিটু বছরের বেশীরভাগ সময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসের কাজ তদারকি করেন। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের নেক নজর থাকায় সে বিনা ছুটিতে ২০১৬ সালে ভারত এবং ২০১৮ সালে মালয়শিয়া ভ্রমন করেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে কাগজে কলমে তিনি পিটিআই প্রশিক্ষনে থাকলেও তাকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় ঝালকাঠি টিইও অথবা ডিপিইও অফিসে। আবার কোনদিন নলছিটি টিইও অফিসে আড্ডা দিতে। মাহতাব হোসেন টিটুর নানা অনিয়ম, দালালী ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে একাধিক।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (অর্থ, রাজস্ব) মো: নুরুল ইসলাম গত ১১ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি আসেন। তিনি নলছিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসে টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সরেজমিন তদন্তের পর প্রায় চার মাস অতিবাহিত হলেও সহকারী পরিচালক মো: নুরুল ইসলাম অজ্ঞাত কারনে কোন প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এ বিষয়ে গত ২৭ জানুয়ারি তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, আমার তদন্ত প্রতিবেদন প্রায় শেষ পর্যায়, মাহতাব হোসেন টিটুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সে বিষয়ে কিছু ভিডিও ফুটেজের সিডি ছিল অভিযোগের সাথে। ওই ভিডিও ফুটেজ এখন আমার হাতে আসেনি। ওটা হাতে আসলেই আমি দেখে রিপোর্ট দিয়ে দেব।
মাহতাব টিটুর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ঃ সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহতাব হোসেন টিটু আরও চারজন শিক্ষক নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এ সিন্ডিকেট দ্বারা নলছিটি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের যাবতীয় বদলী, ছুটি, টেন্ডার প্রক্রিয়া, ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রন করেন। টিটুর নেতৃত্বে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের জন্য খেলার সামগ্রী ক্রয়ের বরাদ্দ থেকে প্রতি বিদ্যালয় থেকে ৫০০/- টাকা হারে সর্বমোট ৯০ হাজার টাকা আদায় করেন। ২০১৭ সনে চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত ৬২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ৬-১০ হাজার টাকা করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে শিক্ষকদের চাহিদামত বিদ্যালয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন ওই সময়ের ডিপিইও ছায়াদুজ্জামানের সহযোগীতায়। ২০১৭-১৮ অর্ত বছরে নলছিটি উপজেলার ২৬ টি পুরাতন বিদ্যালয়ের ভবন নিলামে বিক্রির আয়োজন করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। টিটু তার সহযোগীদের নিয়ে মাত্র তিন লাখ টাকায় ২৬ টি পুরাতন ভবন ক্রয় করে ভবনগুলো ৫২ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে সিংহভাগ টাকা নিজে নিয়ে কিছু টাকা তার সহযোগীদের মধ্যে ভাগবাটোয়রা করে দেন। নতুন শিক্ষক যোগদানের সময় জন প্রতি এক হাজার টাকা দিতে হয় মাহতাব হোসেন টিটুকে। নলছিটি উপজেলার ১৬৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট জনপ্রতি পাঁচশত থেকে একহাজার টাকা, রেস্ট এন্ড রিক্রিয়েশন শিক্ষকপ্রতি পাচশত থেকে একহাজার, যে কোন ধরনের বদলী পাঁচ হাজার থেকে দুই লক্ষ টাকা, মৌখিক ডেপুটেশন জনপ্রতি বিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আদায় করে থাকে। বিভিন্ন অনুদান বরাদ্দে বিদ্যালয়ের নাম অন্তভুক্ত করতে স্কুল প্রতি দশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা, স্লিপ রুটিন মেইনটেনেস থেকে স্কুল প্রতি দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার, ওয়াস ব্লক একহাজার টাকা করে আদায় করেন। এ ছাড়া কোন শিক্ষক পেনশনে গেলে পেনশন প্রতি বিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। গত বছরের জুন মাসে নলছিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসের ফ্লোরে ৯৫ হাজার টাকার ট্ইালস লাগিয়ে তিন লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা বিল উঠিয়ে নেন। সরকারি চাকুরী করেও মাহতাব হোসেন টিটু বেনামে ঠিকাদারী কাজ করেন যাচ্ছেন। বর্তমানে নলছিটি থানার সম্মুখে বড় গেট নির্মান করছেন মাহতাব হোসেন টিটু। মাহতাব হোসেন টিটুর অবৈধ আয়ের নির্দিস্ট পার্সেন্টেজ চলে যায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। যার কারনে টিটুর সকল অবৈধ কাজে সহযোগীতা করেন ডিপিইও এবং টিইও। বিনা ছুটিতে মালয়শিয়া ভ্রমন করলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চাকুরীর সাত বছরে মাহতাব হোসেন টিটু অবৈধভাবে আয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। আর এ অবৈধ টাকায় তিনি বরিশালের রুপাতলীতে সাত শতাংশ জমির ওপর তৈরি করেছেন পাঁচতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি যার তিনতলা পর্যন্ত কমপ্লিট। নলছিটি শহরে তৈরি করেছেন পাঁচতলা ফাউন্ডশেন দোতলা বাড়ি।
এ বিষয়ে মাহতাব হোসেন টিটু বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে দালালীসহ যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। সহকর্মীদের বিপদে আপদে সহযোগিতার জন্য মাঝেমধ্যে অফিসে যেতে হয়। আমি চাকুরীর আগে ঠিকাদারী করতাম। ঠিকাদারীর আয় থেকে আমি বরিশালের রুপাতলী ও নলছিটিতে বাড়ি করেছি। আমার বিরুদ্ধে দুদকে কোন অভিযোগ রয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।
ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। তবে শুনেছি মাহতাব হোসেন টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে ঢাকা মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে একজন সহকারী পরিচালক এসেছিলেন। যে যেহেতু ঢাকার বড় কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন তাই এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।