বগুড়ার প্রমত্তা করতোয়া এখন দখল-দূষণে পচা নর্দমার ড্রেনে পরিণত হচ্ছে

0 ১,৩৪৬

* নাব্যতা ফেরানোর দাবী পরিবেশ আন্দোলনকারীদের ॥

* করতোয়া খনন প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহন করেছে প্রশাসন ॥
বগুড়া প্রতিনিধি:
উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, দখল-দূষণ এবং গতিপথে মানুষের হস্তক্ষেপে বিপন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী করতোয়াও এখন মৃতপ্রায়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক প্রধান তিনটি নদী পদ্মা মেঘনা যমুনা ছাড়াও সরকারি তথ্য মতে ছোট বড় মিলে ৪০৫টি নদীর হিসেব পাওয়া যায়। করতোয়া নদীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা প্রমত্তা করতোয়াকে এখন মৃত নদী। উজান থেকে পানির প্রবাহ নেই। তাই দখল আর আবর্জনার দূষণে এ নদী জর্জরিত। এককালের প্রমত্তা করতোয়া নদী আজ অব্যাহত দখল, শহরের বাসা-বাড়ির বর্জ্য, খনন বা সংস্কার না হওয়া ও দূষণে পচা নর্দমার ড্রেন বা ক্যানেলে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে দিনে শুকুরদের অবাধ বিচরণ। শহর এলাকার মধ্যে দত্তবাড়ি ঘাট, কাজীখানা ঘাট, ডিসি অফিসের সামনের ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় করতোয়া নদীর তীরবর্তী ২৮টি স্পট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ চললেও কেউ দখলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ অহরহ। একদিকে দীর্ঘদিন খনন না হওয়া ও অন্যদিকে দখল চলতে থাকায় বগুড়ার মানচিত্র থেকে প্রমত্তা ‘করতোয়া নদী’ তার ঐহিত্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
কিংবদন্তী রয়েছে, ‘কর’ অর্থ হাত, আর তোয়া অর্থ ধোঁয়া জল, অর্থ্যাৎ হাত ধোয়া জল, হিন্দু ধর্মীয় দেবতা হিমালয়ে ধ্যানমগ্ন শিবের হাত ধোঁয়া জল থেকেই করতোয়া নদীর উৎপত্তি। তাছাড়া বিশিষ্ঠ ইতিহাসবিদ প্রভাত চন্দ্র সেন ‘বগুড়ার ইতিহাস’ গ্রন্থেও ভারতের হিমালয় পাদদেশ থেকে করতোয়া নদীর উৎপত্তির উল্লেখ রয়েছে। ভারতে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে এ নদী প্রবেশ করে। সেখান থেকে করতোয়া বগুড়ার শহরের বুক চিরে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে হুরা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মোট ৫৯৭ কিলোমিটার বা ৩৭৩ মাইল দৈর্ঘ্যের করতোয়া নদীতে আশির দশকে প্রচুর পানি থাকায় প্রমত্তা ছিল। “জনশ্রুতি আছে করতোয়া নদীতে সওদাগরী জাহাজ, লঞ্চ এবং বড় বড় নৌকা বজরা যেটা বলে সেটা যাতায়াত করতো। পণ্য পরিবহন হতো এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুর্ন্ড্রবর্ধন নগরী বগুড়া এবং করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
বগুড়া শহরের শাহ্ ফতেহ আলীর (রহ.) মাজার সংলগ্ন এ নদীতে ঘাট ছিল। পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি থেকে বগুড়া পর্যন্ত প্রায় ৬০কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীর দুই তীরে সেচ দেওয়া যেত। তীরে বসবাসকারীরা খাবার পানি সংগ্রহ ও প্রাত্যহিক কাজ করতেন এ নদীর পানি দিয়ে। খর¯্রােতা হওয়ায় পারাপার খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। ”
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্র্ড ১৯৮৮ সালে উজানে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার খুলশিতে বাধ ও স্যুইচ গেইট নির্মাণ করে । সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের অপরিনাম দর্শিতার কারনে করতোয়ার পানি প্রবাহের গতিপথ সম্পূর্ণ বন্ধ ও ভরাট হয়ে গেছে। সে থেকেই প্রভাবশালীরা ধীরে ধীরে দখল -দূষণ নানা প্রাকৃতিক কারনে বন্যা জনিত ক্ষয়-ক্ষতি ও নদী সংস্কারের অভাবে করতোয়া পূর্বের সকল বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানুষের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ড প্রভাব ফেলেছে করতোয়া নদীর উপর।
বর্তমানে বগুড়া পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ডের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আবর্জনা, ড্রেনের পানি নদীর বুকে এসে পড়ছে। প্রতিদিন বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় ১৫-১৬ টন বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে আর নদীর পানি পচে কালো ও দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। অপর্যাপ্ত পানি প্রবাহ ও দখলবাজদের অবৈধ দখলের কারণে ¯্রােতস্বীনি বেগমতি করতোয়া নদী এখন মৃতপ্রায়। সচল, সজিব, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতিক করতোয়া নদী এখন হয়ে উঠেছে শ্রীহীন, কঙ্কালসার, নিশ্চুপ ও স্থবির। স্বচ্ছ জলপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারনে নদীতে পলি দ্রুতহারে জমে ভরাট হয়ে গেছে।
এদিকে বগুড়ার স্থানীয় জনগণ করতোয়া নদী দখলের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতাকে দায়ী করে অবিলম্বে প্রভাবশালীদের কবল থেকে নদীরক্ষা ও খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখা নদীরক্ষায় গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা) বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, বগুড়াকে বাঁচাতে হলে ব্যাপক পরিবেশগত সচেতনতা ও স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে করতোয়া নদী সচল রাখতে হবে।
বগুড়া সদর আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর এ প্রতিবেদককে জানান, পুর্ন্ড্রবর্ধন নগরী ছেদিত করতোয়া নদীই বগুড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। এ নদীকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নদী ও খাল-বিলের পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী সব ধরনের স্থাপনা অবিলম্বে ভেঙে ফেলার নির্দেশাসহ ডিসিকে জরুরি ভিত্তিতে এবিষয়ে লিখিত নির্দেশনা পাঠাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক নদীর অবৈধ জায়গা উদ্ধারে বগুড়ার করতোয়া নদীর নাম রয়েছে এইসরকারি তালিকায়।
বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ খান রনি, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক তন্ময় সাল্যান জানান, নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং পানির প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখতে ২০১৫ সালের ২২ জুন জেলা প্রশাসকসহ ২১ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করে বেলা নামের সংগঠন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশে জেলা প্রশাসন করতোয়া নদীর সীমানা দখল করে নির্মিত কিছু স্থাপনা অপসারণ করে। কিন্তু নদীর সীমানা নির্ধারণ, গাইবান্ধা-গোবিন্দগঞ্জের কাঁটাখালী খুলশীতে করতোয়ার উৎসমুখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্যুাইস গেইট উন্মুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং দূষণমুক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিরুল ইসলাম করতোয়া নদীর দখল ও দূষণের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশ কার্যকর করতে করতোয়া নদী খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অচিরেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘অবৈধ দখল উচ্ছেদ করলেও তা আবার দখল হয়ে যায়। তাই ওই প্রকল্পের মাধ্যমে নদী খনন ও দুই তীরে ওয়াকওয়ে তৈরি হলে এমনিতে অবৈধ দখলবাজরা উচ্ছেদ হয়ে যাবে। নতুন করে নদীর তীর দখল হবে না।’ তবে করতোয়া নদীর নাব্যতা ফেরাতে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ৭ কিলোমিটার ও বগুড়া এলাকায় ১১২ কিলোমিটার মিলে মোট ১১৯ কিলোমিটার নদী খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া তদসহ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.