হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার মাটির ঘর

0 ১৬২
ছবিক্যাপশন-আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম-গঞ্জ, অজোপাড়া-গাঁ থেকে মাটির ঘর। একটি মাটির ঘরের ছবি।

ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি:  আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর। মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-পাথরের আর টাইলস্ দিয়ে গড়া দালান। একটু সুখের আশায় মানুষ কত কিছুই না করছে। তবে মাটির ঘরের শান্তি ইট পাথরের দালান কোঠায় খুঁজে পাওয়া দায়। যেমনটি এখন ইটের ঘর তৈরী শেষে ঐ ঘরকেই আরো সৌন্দের্য্যরে জন্য মানুষ টাইলস্ দিয়ে কারুকার্য খচিত নক্সায় ব্যাপক আলীশান বাড়ী তৈরীতে ব্যস্ত। আগের সময়ের চেয়ে মানুষের হাতে বর্তমানে প্রচুর অর্থ রয়েছে, যা দিয়ে তাঁরা বৈধ-অবৈধভাবে আয়ের টাকায় কোনো পথ না পেয়ে তৈরী করছে আলীশান ব্যয়বহুল বাড়ী দালান-কৌঠা।

আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের বিবর্তনে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ নয়। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে এ চিরচেনা মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। অতীতে মাটির ঘর গরীবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে পরিচিত ছিল। এ ঘর শীত ও গরম মৌসুম আরামদায়ক তাই আরামের জন্য গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি অনেক বিত্তবানও মাটির ঘর তৈরি করে থাকতেন। আগের যুগের মানুষের ধ্যান-ধারনায় ছিলো আলাদা।

সেই মান্দাত্তা আমলের বয়স্ক গুরুজনকে যদি এখন খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে এখনো বলবে, তাঁদের আমলের চিড়াচড়িত কথা। কারণ, তাদের সময়ে এই টাকার মূল্য ছিলো অনেক বেশী। আমাদের এখন যে টাকা হাজার টাকা, তাঁদের আমলে সেই হাজার টাকাই ছিলো ১’শ টাকার সমান। তাহলে ভাবা যায় কি তাঁদের আমলে টাকার কি মূল্য ছিলো? বাপ-দাদারা এখনো বলে থাকে, এক টাকায় তারা ১৬ কেজি কিনেছে। তাহলে বর্তমান প্রজন্মের কাছে বলা গেলে তাঁরা হাসি-ঠাট্টা আর বিদ্রুপ করবে। কারণ, সেই আমলের চাউল আর এই আমলের চাউল একই চাউল। কিন্তু দামের বেলায় পার্থক্য।

জানা যায় যে, প্রাচীণকাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন ছিল। এটেল বা আঠালো মাটি কাঁদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়-থড় অথবা টিনের ছাউনি দেয়া হতো। মাটির ঘর অনেক জায়গায় যেমন বগুড়ার কিছু গ্রামে এখনো দোতলা-তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ী পরিলক্ষিত হয়েছে। আর এই দোতলা বাড়ী এখনকার সময়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও পারবে না, সেই মাটির ঘরের সাথে পাল্লা দিতে। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের তিন-চার মাসের অধিক সময় লাগতো। গৃহিনীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তুলতেন।

এক সময় উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক পরিবার মাটির ঘরে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনো মাঝে মাঝে চোখে পড়ে চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী এই মাটির ঘর। তবে বর্তমান সময়ে সকলস্তরের মানুষের হাতে প্রচুর পরিমানে টাকা থাকায় এখন তাঁরা আর মাটির ঘরের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। সবাই চাইছে কিছু বেশী খরচ হলেও পাকা দালান ঘর তৈরীতে ব্যস্ত সবাই। এখনকার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু অর্থশালী লোকেরা তো করছেই।

মধ্যম শ্রেণীর মানুষেরা এখন ঝুকেছে, আলীশান বাড়ী-ঘর তৈরীতে। এমনকি একজন ভিক্ষুকেরও পাকা দালান বাড়ী রয়েছে, পরিলক্ষিত হয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, মধ্যবৃত্ত ও নিম্বৃত্তদের চেয়ে বর্তমান সময়ে একজন প্রকৃত ভিক্ষুকও পরোম-আনন্দে আর সুখে-শান্তিতে দিনযাপন করছে। কারণ, আগের চেয়ে মানুষ এখন কুরআন-হাদিসের প্রতি অবগত। তাই তারা কোনো ফকির-মিশকিন চাইতে এলে কোনো সময় খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলা ভোলাহাট, গোমস্তাপুর, নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও

বিরাটাকার শিবগঞ্জ। এই উপজেলাগুলির কিছু কিছু এলাকায় সরজমিনে গিয়ে কয়েক জনের বাড়ী এখনো মাটির কারুখচিত ঘর প্রত্যক্ষ করা গেছে। ভোলাহাট উপজেলার বৃহত্তর বজরাটেক গ্রামের আব্দুল হামিদ জানান, এই ঘর আমার দাদার ছিল। সে মারা যাওয়ার পর আমার বাবা থাকতেন। এখনও ঘরটি রয়েছে। দাদার পুরোনো স্মৃতি ধরে রাখতে এখনো মাটির ঘরটি যতœসহকারে রেখে দিয়েছি। তবে যুগের সাথে তাল মেলাতে এখন অনেকে ইটের ঘর তৈরি করছে, তাই ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর।

আলীসাহাসপুরের ভাদু মিয়া বলেন, মাটির ঘরে সব সময় ঠান্ডা থাকে। গরমের দিনে যেমন ঘরে বসে ভালো ভাবে থাকা যায়, তেমনি শীতের দিনেও কনকনে শীতের মধ্যে হলেও মাটির ঘরের মধ্যে তেমন শীত লাগে না এবং বাহিরের চেয়ে সেই মাটির ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আলাদা একটা গরমভাব মনে হয়। এমনকি এই মাটির ঘরকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনে হয়।

খাদেমুল হক নামে একজন জানান, বাবার আমল থেকেই মাটির ঘর দেখতাছি। তাই নিজে মাটির ঘর ভেঙ্গে নতুন করে ঘর দিচ্ছি। ভবিষ্যতে ছেলে-সন্তান এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায় না। আরেক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, অনেকেই একে-অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করেও প্রতিযোগিতামূলক ভাবে পাকা দালান ঘর তৈরী করতে দেখা গেছে।

ভোলাহাট উপজেলার মোঃ শরিফ আলী জানান, মাটির ঘর বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের বিবর্তনে অধিকাংশই মানুষ মাটির ঘর ভেঙে অধিক নিরাপত্তার জন্য পাকা ঘর তৈরি করছে সকলে। পাকা আর কাঁচার ঘরের ভালমন্দ বাচবিচার না জেনেই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন বেশীরভাগ মানুষ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.