দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: ভাঙা বোতল, মাটির পাত্রসহ ফেলনা পাত্রটিও যে প্রয়োজন মেটাতে পারে এমনটাই জানিয়ে-বুঝিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে হাতে কলমে কৃষি বিষয়ক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তুলছে ‘ছাদকৃষি লার্নিং সেন্টার’ বা কৃষি পাঠাগার। এ সেন্টার থেকে শিক্ষা নিয়ে ফুল, ফল, ক্যাকটাস এমনকি ঔষধি গাছ থেকে শুরু করে সবজির বাগান গড়ে পরিবারের চাহিদা মেটাচ্ছে। সেই সাথে খুঁজে পাচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার সহজ পথ। এ সেন্টার থেকে শত শত মানুষ বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছাদবাগান গড়ে সফলতা পেয়েছেন। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আদনান বাবুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ‘ছাদকৃষি লার্নিং সেন্টার’। সপ্তাহে প্রতি সোমবার করে এ সেন্টার থেকে কৃষির নানা আধুনিক তথ্য এবং প্রযুক্তিগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে উপজেলা কৃষি অফিস চত্ত্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে বসে। শুধু ওই এলাকায়ই নয়, এ সেন্টার থেকে শিক্ষা নিয়ে জেলার আশেপাশের উপজেলার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের পথ আলোকিত করছে।
নন্দীগ্রামে ইতোমধ্যে সরিষাবাদের রইচ উদ্দিন, বুড়ইল দক্ষিণপাড়ার সেলিম রেজা, বড় চাঙ্গুইরের পলককুমার সাহার বাড়ির ছাদসহ ৩০টি বাড়ির ছাদে এ সেন্টারের আদলে ছাদকৃষির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন ছাদকৃষি করে সফলতা পেয়েছেন।
জানা যায়, জেলার কৃষিতে সমৃদ্ধ এক জনপদ নন্দীগ্রাম উপজেলা। এ উপজেলায় প্রধান ফসল ধান হলেও পিছিয়ে নেই আলু, সরিষা, মরিচসহ অন্যান্য সবজি ও ফল উৎপাদনে। বোরো, আউশ ও আমন ধান উৎপাদনে জেলায় শীর্ষে রয়েছে এ জনপদের অবস্থান। উচ্চমূল্যের ফসল স্ট্রবেরি, ড্রাগন, সৌদি খেজুর, ক্যাপসিকাম, মিশ্র ফলবাগান, পানিফল, বারোমাসি তরমুজের আবাদ নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষিকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা। আর কৃষিকে আরো উন্নয়মুখী ও কর্মসংস্থান হিসেবে গড়ে তুলতেই নিজের প্রচেষ্টায় ‘ছাদ কৃষি লার্নিং সেন্টার’ নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আদনান বাবু। ২০২১ সালের অক্টোবরে গড়ে ওঠা এ সেন্টার থেকে দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে ৫ শতাধিক শ্রেণি- পেশার মানুষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ছাদে বাগান গড়ে সফলতা পেয়েছেন।
যে-কেউ খুব সহজেই বিভিন্ন উপকরণ সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান লাভ করতে পারবেন। এ ছাড়া পরিত্যক্ত বোতলে পিঁয়াজ চাষ, খালি বস্তা ব্যবহার করে খুব সহজেই আদা, হলুদ চাষের অভিনব প্রযুক্তিগুলোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ছাদে রয়েছে সবজি কর্নার, ফুলের কর্নার এবং ফলের কর্নার। সবজি কর্নারে লাগিয়েছেন করলা, চিচিঙ্গা, টম্যাটো, বেগুন, মরিচ, লাউ, ঢ্যাঁড়শ, পেঁপে, শসাসহ প্রায় ২০ রকম সবজি। এ সবজিগুলোর মাচা তৈরি করা হয়েছে একটু ভিন্নভাবে।
ফুলের কর্নারে শোভা ছড়াচ্ছে পয়েনসেটিয়া, অ্যাজিলিয়া, সিজিয়াম, বেলি, সাদা নয়নতারা, গোলাপি নয়নতারা, কমলা রঙ্গন, লাল রঙ্গন, লাল জবা, সাদা জবা, কমলা জবা, স্থলপদ্ম, বাগানবিলাস, পাতাবাহার, ক্যাকটাস, পর্তুলিকাসহ শোভাবর্ধনকারী নানাবিধ গাছ। ফলের কর্নারে রয়েছে বারোমাসি আম, অগ্নিশ্বর কলা, থাই পেয়ারা, দেশি মাল্টা, আমড়া, কামরাঙা, লেবু, কদবেল, জাম্বুরা, সুইট লেমন, শরিফাসহ নানা প্রজাতির ফলগাছ। বিদেশি ফলগাছের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। রয়েছে ড্রাগন, কমলা, চায়নিজ কমলা, ভেরি গেটেড মাল্টা ইত্যাদি। ছাদকৃষির পাশাপাশি মাঠকৃষিরও নানা প্রযুক্তি এখানে রয়েছে। পোকা দমন, হলুদ আঠালো ফাঁদের ব্যবহার করে সহজেই উড়ন্ত পোকা দমন ব্যবস্থারও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
তাছাড়া ওই ‘ছাদ কৃষি লার্নিং সেন্টার’ বা কৃষি পাঠাগারের সংগ্রহশালায় রয়েছে প্রায় ৭ শতাধিক বই এবং পুস্তিকার সমাহার। রয়েছে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জৈব সার উৎপাদন, আধুনিক পদ্ধতিতে ধান, সবজি, ফল চাষ, ছাদ বাগান সহ কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নিয়ে বিশেষজ্ঞ লেখকদের লেখা বই। মূলত শিক্ষিত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে কৃষিতে আগ্রহী করে তুলতে কাজ করছে এই পাঠাগার বা ‘ছাদ কৃষি লার্নিং সেন্টার’।
বড় চাঙ্গুইরের পলককুমার সাহা জানান, প্রথমে ‘ছাদকৃষি লার্নিং সেন্টার’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন জাতের ফুল ও ফলের চারা সংগ্রহ করে বাগান গড়েছেন। তিনি তাঁর ছাদে লাউ, বিভিন্ন প্রকার শাক, ঢ্যাঁড়শ, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করেছেন। সবজির বাগান থেকে যে ফলন পান তা দিয়ে পরিবারের চলে যায়। সবজিগুলো তাজা ও দূষণমুক্ত। যেটি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ভালো রাখছে।
সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ আদনান বাবু বলেন, কৃষির নানা আধুনিক জ্ঞান-প্রযুক্তি শিক্ষিত তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এই কৃষি পাঠাগার বা ‘ছাদ কৃষি লার্নিং সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে। কৃষির উপর লেখা একসাথে এতগুলো বই দেখে সকলেই উচ্ছসিত। এ সেন্টারের সহায়তায় প্রশিক্ষিত প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজ পরিবারের সবজি ও অন্যান্য ফল, ফুল ছাদ থেকেই পাবে। এতে করে অর্থ বাঁচবে, জোগান বাড়বে। তাছাড়া আগামী দিনে কৃষিতে আরো নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরীতে ভূমিকা রাখবে এ ধরণের কৃষি পাঠাগার বা কৃষি লার্নিং সেন্টার।